স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁয়ে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বহুল কাক্সিক্ষত মেট্রোরেল। ইতিমধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের ৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মূল সড়ক ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে কাজ। সড়কের পাশের উঁচু ভবনগুলোর ছাদ থেকে দেখা যায় মেট্রোরেলের পথ। ঠুকঠাক চলছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। পুরো শহর ঘুমিয়ে গেলেও মেট্রোরেলের কাজ চলে। পথের ওপর ঢালাই আর ট্র্যাকের কাজ চলছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের ঘুম বলে কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু রেলপথ।
সম্প্রতি উত্তরা, দিয়াবাড়ী, আগারগাঁও, মতিঝিল, কমলাপুর, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এবং প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেট্রোরেল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে হবে জনগণকে দেওয়া সরকারের বিশেষ উপহার। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে কয়েক মাস কাজ বন্ধ থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতায় প্রকল্প কর্র্তৃপক্ষ দ্বিতীয় ঢেউয়ে যেন কোনোভাবেই কাজ বন্ধ না থাকে সেই ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ১৬ ডিসেম্বরেই হতে পারে উদ্বোধন।
প্রথমেই ১ নম্বর স্টেশন অর্থাৎ উত্তরা-দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর পর্যন্ত ৯টি স্টেশনের কাজ শেষ করা হচ্ছে। আবার এ অংশে পরীক্ষামূলক চলাচলের জন্য জাপানে তৈরি হচ্ছে ট্রেন। গত এপ্রিলে একটি, সেপ্টেম্বরে একটি ট্রেন তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। আর এ মাসের মধ্যে শেষ হবে আরও তিনটি।
গত শুক্রবার দিয়াবাড়ীর ১ নম্বর স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পুরোদমে কাজ চলছে। বিকেলে অনেক মানুষ দিয়াবাড়ী ঘুরতে এসে মেট্রোরেলের উড়ালপথের সঙ্গে ছবি তুলছেন। রেলপথের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে সড়কে চাপ কমবে। অনেক দূর থেকে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। উত্তরা থেকে মতিঝিলে অফিস করা কোনো সমস্যাই হবে না। দিয়াবাড়ীর অংশে কাজ করা শ্রমিকরা দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদকদের বলেন, আমরা কাজের ফাঁকে চা খেতে এলে সবাই জানতে চান, কাজ কতদূর। দেরি হবে কি-না? আমাদেরও ভালো লাগে এ রকম একটি বড় কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি বলে। ছুটিতে বাড়ি গেলে সবাই জানতে চান কীভাবে শূন্যে ট্রেন চলবে। গ্রামের মানুষদের অনেকেই ভাবতে পারেন না এভাবে রেল চলতে পারে। আর উত্তরা, মিরপুরসহ মতিঝিলের অফিসপাড়ার মানুষদের কাছে তো সাধনার মতো মেট্রোরেল। কবে চালু হবে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকা থেকে মুক্ত হবে।
প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মনোজ কুমার বলেন, ‘দিয়াবাড়ী অংশে ৫২টি স্থাপনার কাজ চলছে। সবাই যখন ঘুমায় আমরা তখন রেলপথের ঢালাই ও ট্র্যাকের কাজ করি। রাতে তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম থাকে। কারিগরি কারণেই রাতের বেলায় এই কাজ করতে হয়। ৩১ ডিগ্রি তাপমাত্রার ওপর কাজ করলে অ্যাঙ্কর বোর্ড সরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে সূর্যের তাপে স্লিপার সম্প্রসারণের ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই মেট্রোরেলের ট্র্যাকের কাজ রাতেই করা হচ্ছে। ২-৩ শিফটে কাজ হচ্ছে।’
প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক সম্প্রতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে বলে আশা করি। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে না। উল্টো মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটারের বর্ধিত অংশ এই প্রকল্পের টাকার মধ্যে ব্যয় করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায়ও কাজ করার প্রস্তুতি রয়েছে। এর মধ্যে জাপান দুটি ট্রেনের কাজ শেষ করেছে।’
জানা গেছে, ইতিমধ্যে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের উড়ালপথ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এর ওপর এখন রেল স্লিপার বসানোর কাজ চলছে। ৯টি স্টেশনের কাঠামোর কাজও শেষ। উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের হলঘরের ছাদ নির্মাণ শেষ হয়েছে। পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া স্টেশনের হলঘরের নির্মাণকাজ চলছে। উত্তরা মধ্য ও উত্তরা দক্ষিণের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণকাজ শেষ। উত্তরা উত্তরের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে। এই তিনটি স্টেশনে এখন কারিগরি ও বৈদ্যুতিক কাজ শুরু হয়েছে। আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের পিলার নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প অর্থাৎ দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের দূরত্ব ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৫৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সরকার চাইছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার চালু করতে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে দ্রুতগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ওই অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। উত্তরা-আগারগাঁও অংশের কাজের অগ্রগতি ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের ৪৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
তারা আরও জানিয়েছেন, জাপানের কাওয়াসাকিতে চলছে মেট্রোরেলের কোচ নির্মাণের কাজ। প্রতি সেটে থাকবে ৬টি করে বগি। প্রথম পর্যায়ে ৫ সেট কোচের মাধ্যমে মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরু হবে। ইতিমধ্যে ২ সেট কোচ নির্মাণ শেষ হয়েছে। চলতি মাসেই বাকি ৩ সেট কোচ নির্মাণ শেষ হবে। বাকি ১৯ সেট কোচ আগামী বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে আসবে। প্রথম পর্যায়ে একটি কোচ থাকবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত। আসছে জানুয়ারিতেই এই ৫ সেট কোচ পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে। এজন্য উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য ও উত্তরা দক্ষিণের স্টেশন পুরোপুরি প্রস্তুতের কাজ চলছে।
উত্তরার দিয়াবাড়ীতেও দ্রুততার সঙ্গে চলছে মেট্রোরেলের ডিপো এলাকার ৫২টি অবকাঠামো নির্মাণকাজ। এখান থেকে প্রতিদিন ভোর ৫টায় মেট্রোরেল ছেড়ে যাবে। মধ্যরাতের বিরতিতে হবে ধোয়ামোছা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। ইতিমধ্যে ওয়ার্কশপ, স্ট্যাবলিং শিল্ড নির্মাণ শেষ হয়েছে। ডিপো এলাকার ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন শেষ হয়েছে। সফটওয়্যার সিস্টেমসহ ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল অংশ নিয়ে প্যাকেজের কাজও শেষ হয়ে গেছে অর্ধেক।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় গতি আনতে মেট্রোরেল করার চিন্তাভাবনা শুরু হয় গত শতকের শেষ দিক থেকেই। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই চিন্তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এ নিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রাজধানীজুড়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও মেট্রোরেল নির্মাণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পর্যায়ে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার উড়ালপথে এ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ জন্য ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকা ও ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা স্থানীয়ভাবে জোগানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নকশা জটিলতার কারণে প্রকল্পটি আটকে ছিল। নকশা সংশোধন শেষে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এটির অনুমোদন দেয়। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
নকশা অনুযায়ী মেট্রোরেল মাটি থেকে ১৩ মিটার ওপরে স্থাপিত। যাত্রী ওঠা-নামার জন্য থাকবে ১৬টি স্টেশন। এগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় ও মতিঝিল। তিন তলাবিশিষ্ট স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার এবং অন্য সুবিধাদি। প্ল্যাটফর্ম থাকবে তৃতীয় তলায়। স্টেশনগুলোতে ওঠার জন্য সাধারণ সিঁড়ির পাশাপাশি থাকবে লিফট ও চলন্ত সিঁড়ি। টিকিট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের ব্যবস্থা হবে স্বয়ংক্রিয়। নিরাপত্তার জন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নিরাপত্তা বেষ্টনী বা প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর স্থাপন করা হবে।
প্রথমে এটি আগারগাঁও হয়ে বিজয় সরণি থেকে মতিঝিল যাওয়ার কথা ছিল। পরে নকশায় সংশোধন এনে খামারবাড়ি হয়ে মতিঝিল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির নামে পরিচালিত এই প্রকল্পটি কাজের সুবিধার্থে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালে পুরো প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় সেই অবস্থান থেকে সরে আসে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে সিপি-১ থেকে সিপি-৪ অর্থাৎ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এ অংশে স্টেশন সংখ্যা ৯টি। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অর্থাৎ সিপি-৫ ও সিপি-৬ অংশের কাজ ২০২৪ সালের মধ্যে শেষের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পুরো প্রকল্পটি চালু হলে মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছানো যাবে। দিনে যাত্রী পরিবহন করতে পারবে ৫ লাখের কাছাকাছি।