ডেস্ক নিউজ
বিদ্যমান ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই এক প্রতিবেদনে। যদিও সীমা তুলে দিলে ব্যবসার খরচ বেড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে। এর পরও উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির এ সময়ে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। সীমা তুলে দেওয়ার কারণে একবারে সুদহার যেন অনেক বেড়ে না যায় সেজন্য ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পক্ষকে গবেষণার বিষয়বস্তু অবহিত করে গত বৃহস্পতিবার তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার এ সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এরই মধ্যে সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ঋণ চাহিদা কমানোর পন্থা বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে সাবেক অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বলে আসছেন, সুদহারের সীমা তুলবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে যে ঋণ বাড়ছে তার বেশিরভাগই বিনিয়োগে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে সীমা তুলে দিলে সুদহার অনেক বেড়ে যাবে।
ফলে সীমা না তুলে ব্যাংকগুলোর তহবিল খরচ বাড়ানোর মাধ্যমে ঋণ কমানো হবে। বর্তমানে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলও গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সুদহারের বিদ্যমান সীমা প্রত্যাহারের কথা বলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুদহারের সীমা এবং সম্ভাব্য বিকল্প নীতির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুদহারের সীমা আরোপ শিল্প খাতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মোট ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ গেছে এ খাতে। তবে কৃষি, কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের অংশ কমেছে। সুদহার কম থাকায় ঋণ চাহিদা বাড়লেও আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এতে চাহিদা ও সরবরাহে অমিল দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিল কমেছে। অবশ্য ইতোমধ্যে আমদানি চাহিদা নিয়ন্ত্রণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে চলমান সরবরাহের অমিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় হতে পারে একটি উপযুক্ত সমাধান। এ অবস্থায় সুদহারের ওপর বিদ্যমান সীমা একবারে বাতিল করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, সুদহারে সীমা আরোপ কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক না। বর্তমানে মূল্যস্ম্ফীতি ঊর্ধ্বমুখিতার এ সময়ে এটা আরও সংকট তৈরি করেছে। কেননা, আমানত সেভাবে বাড়ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোও চাহিদামতো ঋণ দিতে পারছে না। সীমা তুলে দিলে আমানতের পাশাপাশি হয়তো ঋণের সুদহারও বাড়বে। তবে সেটি অস্বাভাবিক পর্যায়ে যাবে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সুদহার কমে যাওয়ায় মানুষ সেভাবে ব্যাংকে টাকা রাখছে না। এতে করে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে ব্যাংকগুলোর। আবার বিনিময় হারজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশি ঋণও কমছে। তবে সুদহারের সীমা তুলে দিলে আমানত বাড়বে। তাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও বাড়বে। সুদহার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের গবেষণাপত্র ইঙ্গিত করে আগামীতে এদিকেই যাবে যা ইতিবাচক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সুদহার কম থাকলে মানুষের মধ্যে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আর মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যা সাংঘর্ষিক। বৈশ্বিক কারণে এমনিতেই এখন মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ছে। ফলে এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখন সেদিকেই যাচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সুদহারের সীমা একবারে না তুললেও এটা বাড়িয়ে ১০ বা ১১ শতাংশ করা যেতে পারে। যে সময়ে সুদহারে সীমা আরোপ করা হয়েছিল, তখনকার বাস্তবতায় সেটা ঠিক ছিল। এখন মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা বাঞ্ছনীয়। যদিও সুদহারের সীমা তোলা না-তোলা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তের বিষয়।
মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদহারের সীমা আরোপের কোনো সুযোগ নেই। তবে অর্থমন্ত্রীর তৎপরতায় ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা কার্যকর করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর আমানতের সুদ তলানিতে নামতে থাকায় গত বছরের আগস্টের এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে তিন মাস আগের গড় মূল্যস্ম্ফীতির কম সুদ না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমার কারণে বেশিরভাগ ব্যাংক এই নির্দেশনা মানছে না। যে কারণে আমানতের সুদহার না বেড়ে ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত আগস্ট শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার কমে ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে নেমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যা ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ ছিল। এ পরিস্থিতিতে বেশি লাভের আশায় অনেকে এখন ব্যাংকে টাকা না রেখে উচ্চ সুদের টোপ দেওয়া বিভিন্ন হায়-হায় কোম্পানিতে রাখছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। যে কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশের ওপরে উঠলেও আমানত প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. জুলহাস উদ্দিন, পরিচালক (সাবেক মহাব্যবস্থাপক) ড. সায়েরা ইউনুস এবং অপর কর্মকর্তা তারেক আজিজ এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশের আগে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের (বিআইজিএম) পরিচালক ও অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, চার ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিসহ বিভিন্ন পক্ষকে অবহিত করা হয়।