ঘন জোঁছনায় ভরা আকাশ। আজ চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে।
নীলাভ আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পৃথিবীকে একাকার করে ছিটাচ্ছে রোশনাই আলো, অকৃপন আর অকাতরে। আলোর বন্যায় ভাসছে ধরণী। অন্ধকার কেটে গেছে। নিশুতি রাতে আকাশ জুড়ে আলোকময় হয়ে জ্বলজ্বল করছে বুদ্ধ পূর্নিমার ঝলমলে চাঁদ। কার যেন অজানা ইশারায় ঘর থেকে বেড়িয়ে অজানায় চলে যেতে মন চায়। ঘুমকাড়া মায়াভরা এ মোহিনী রাতে। গৃহত্যাগী হবার সব আয়োজন আছে আজ । শুধু নেই কেউ পথে নামার। এ রাতের মায়ায় সব ফেলে বেড়িয়ে পড়বে অজানার দেশে।
ধ্যানমগ্নতায় পাথর হয়ে,
বিধাতাকে আমন্ত্রণ অথবা মুক্তির মন্ত্র জানার ব্যকুলতায় কেঁদে ওঠে না আজ কারো মন। মুক্তি সেতো সদূর পরাহত। দু:খের কারণ আবিস্কার করা গেলেও কুঠার আঘাতে তাকে শেষ করা যায়নি। আছে দু:খ, কষ্ঠ, শোক, মায়া, লোভ আর ঘৃণা। আগের মতই। অথবা বেড়েছে বহুগুন। কোন দাওয়া্ই আর করছে না কাজ। আশা জাগানিয়া । চাঁদের মাঝে দেবদূত ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথিবীর অনাচার দেখে। মূখ টীপে মৃদু হাসি হাসে, কঠিন অনড় ধ্যানমগ্ন মূখ। এ আলোকিত রাত আর ডাকেনা হাত তুলে চলে আয় সব ফেলে। অথবা সে হারিয়েছ কাছে টানার, ফেরারি করার ক্ষমতা। বাতাস ঘুমিয়ে আছে, পাথিদের সাথে অনড় গাছের পাতা। আলোয় উঠছে ভরে মায়াময় ধান ক্ষেত, গ্রাম, পথ আর নদী। আলোয় আলোয় আধাঁরের ছোঁয়া কেটে পাখিদের ঘুম ভেংগে যায়। সুনশান নীরবতা। দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ালের হুক্কা হুয়া। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে ভয় মেশানো নেশা। দিনের আলোর মত সবকিছু তাপহীন পরিস্কার, যত দুর চোখ যায়। আলোর বন্যায় একাকার, ভেঁসে যায় নিমেষেই সব। অঘোরে ঘুমায় পৃথিবীর সব চেনা মূখ। কেউ কেউ জেগে থাকে। কারো কারো ঘোঁর লেগে যায়। মিটে যায় রাজা হবার সাঁধ, বেঁচে নেয় কঠোর জীবন। তপস্যা, ধ্যান।
বাড়ির সামনে পুকুর। জলে ভরা।
পুকুর পাড়ে গাছ। ভরা জোছনার আলো, গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে মোহময় করে তোলে পরিবেশ। চিকমিকি ঢেউ খেলে আলো যায় মিলিয়ে জলের উপর । সোনালী মাছেরা ডানা ধরে মেলে, উড়ে যেতে চায়। এরপর সড়ক পেড়িয়ে যৌবণবতী ধানক্ষেত। তাতে সোনা রং ধরেনি এখনো। চারিদিকে সবুজের সমারহ। তার ওপারে ছোট নদী, কাটা নদী। বয়ে চলে নিরবধি, সময়ের তালে তালে হারিয়ে গতি দিশেহারা আজ। পেরিয়েছে সময়, ঢেউ খেলা, পাল তোলা নৌকার যৌবন । বুকভরা মাছ আর প্রাণ ভরা ঢেউ। যুবতী নদীর মনকাড়া এ রুপ এলাকায় কতদিন দেখেনিকো কেউ। একদিন রঙ এ রসে ভরা ছিল, প্রাণ ছিল পাল তোলা গান ছিল। বয়সের ভারে আজ নুয়ে পড়া প্রাণহীন অসাড়। মাঝরাতে জাল ফেলে করে না অপেক্ষা কেউ কিংবা জানান দেয় না আজ মাঝির চিৎকার, জেগে আছি। অথবা দিনভর শিশুদের মাতামাতি, ঝাঁপাঝাঁপি। জল মেখে ডুবন্ত সাতার। নদীদেরও দু:খ আছে, শোক আছে, নারীদের মতো। গতি হারানোর কাতরতায় বেদনা বিধূর। জনপদে পড়ে এর প্রভাব। নদী, প্রকৃতি আর মানুষ তিনে মিলে মিলেমিশে একাকার। মানুষ হারিয়ে গতি নদীর মতো বন্ধা বনে যায়। আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্ঠা তাই অবিরত।
নদীর পাশ ঘেঁষে শশ্বান।
পোড়া ভস্মে ভেঁসে গেছে স্বজনের দেহ এনদীর জলে। মিশে আছে প্রেমমাখা চোখের বিদায় অশ্রু। জল তাকে ফেরায়নি, করেছে গ্রহণ। দূর থেকে সবকিছু আলোকময় হয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। আত্নারা জেগে ওঠে এই ক্ষণে, এই দিনে। চেনা ঘাট, চেনা নদী, অচেনা তাদের কাছে। কতদিন হয়নিকো ফিরেদেখা। স্বজনের প্রিয় মুখ, চেনা ছবি সবকিছু অচেনা আজ । আচমকা সম্বিৎ ফিরে যখন তাকাই দেখি কার যেন হাত নাড়া দূর থেকে। চেনা চেনা লাগে। ফিঁস ফিঁস করে বলে কাছে আয়। তোর অপেক্ষায় আজ ফিরে আসা। এ আহব্বান উপেক্ষা করে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার সাধ্য কার। অনিচ্ছায় এগিয়ে চলে পা। নিশুতি মাঝরাতে একা একা। পিছনে পড়ে থাকে নিবাস আর আপনার জন। অজনার মোহ আজ পেয়ে বসে, নিশিডাক বড়ই মধুর। উপেক্ষা করার সাধ্য নেই, সাধ নেই, বাঁধাহীন পথ। কে কাহারে ফেরাবে বল আজ। মানুষের নেই কোন আলাদা পরিচয়।
মগ্ন জোছনায় ডুবে গেলে,
সবকিছু ফেলে মরে যেতে মন চায়। থাকেনা জীবনের পিছু টান। প্রেম, মায়া, দু:খ, জ্বরা, ক্লান্তি, হিংসা, ঘৃনা আর লোভ ভুলে হালকা তুলোর মতো লাগে এমানব জনম। মায়ার ঘোরে নিভে যায় জীবনের স্বাভাবিক গতি। ফিরে আসে নতুন পৃথিবী। নদী ভরে উঠে মাছে, জলে আর নৌকায়। জনপদ জেগে ওঠে, নতুন মায়ায়। পাখিদের ডাকাডাকি, প্রজাপতি ডানা দেয় মেলে। ধ্যানমগ্ন নিথর দেহ চাঁদের মাঝে বসে মূখ টিপে হাসে। আজো হয়নিকো শেষ যে যাত্রা, সে করেছিলো শুরু। কাটেনি পাথর সময়। মুক্তি পায়নি মানুষ ব্যাধি, জ্বরা আর গ্লানি থেকে। আজো তাই চাঁদ উঠে, মায়াময় আলো জ্বেলে খোঁজে ফেরে। আসবে নতুন মুখ যে দেখাবে আলো, পাড়ি দিবে কঠিন প্রহর। যে পালায় সেই শুধু জানে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, পালানোর মাঝে। সবাই পারে না, কেউ কেউ তাই গৃহত্যাগী হয়। রাজা থেকে মহারাজ হবার বাসনায়।