ডেস্ক নিউজ
পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এরপর শুরু হয় দেশব্যাপী ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মূল কাজ। সেই স্বপ্নযাত্রায় সারাদেশে ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামোর নির্মাণকাজ এখন দৃশ্যমান। সরকারি-বেসরকারি ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মাণকাজ শেষে আনুষ্ঠানিক উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে ১৪ শিল্পকারখানা।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগামী ২৬ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) ৫০টি শিল্প ইউনিট, প্রকল্প ও ভবন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৯৬ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৯ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০১.৩৭ টাকা ধরে)।
এ সব শিল্পে ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৪০৭ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং শীঘ্রই তা বেড়ে ৩৮ হাজার ৬৫৮ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে জানা গেছে। এতে শিল্পায়নে নতুন মাত্রা পাবে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বিনিয়োগের সব সুযোগ দিয়ে একটি অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্পায়ন করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সালে শুরু হয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মূল কাজ। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজের শুভ সূচনা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের উন্নয়ন কাজ স্থবির হয়ে পড়লেও বেজা চেষ্টা করেছে তার কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার। এরই ধারাবাহিকতায় বেজা আগামী ২৬ অক্টোবর ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৫০টি শিল্প ও অবকাঠামো উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-২০২২’ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, পরিকল্পিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সরকার ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে ২৮টি বর্তমানে উন্নয়নাধীন রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক শিল্পোৎপাদন শুরু করেছে এবং আরও ৬১টি শিল্প নির্মাণাধীন রয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১২টি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছে এবং এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থাপিত এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বার্ষিক ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি করবে বলে আশা করছে বেজা।
বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি সুবিধা পাবেন। জাপান, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশ সরাসরি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন ‘প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে ইজেডগুলোতে ভার্চুয়ালি ৫০টি শিল্প ইউনিট, প্রকল্প ও ভবন উদ্বোধন করবেন। আটটি ভেন্যুতে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে বেজা। উদ্বোধন হতে যাওয়া ইজেড সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএসএমএসএন, জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল, শ্রীহট্ট ইজেড এবং সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের প্রশাসনিক ভবন।’
এর মধ্যে দুটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলও রয়েছে বলে তিনি জানান। এগুলো হলো- কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পূর্বগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি বেজার বিনিয়োগকারীদের এবং ‘২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ’ বিনির্মানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি জানান। শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ওয়ান স্টপ সেবা দেয় বেজা।
বিনিয়োগকারীদের থেকে আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে পরিমাণে জমি আছে তার চেয়ে বিনিয়োগকারীর চাহিদা বেশি। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন করছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইউটিলিটি কানেকশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নেটওয়ার্কিং এগুলো আমরা করে দেই।’
বেজা সূত্রে জানা গেছে, ১৪টি শিল্প-কারখানার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই ১৪টির মধ্যে একটি হলো ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যারা প্রি-ফেব্রিকেটেড স্ট্রাকচারাল স্টিল তৈরি করে, যা স্টিল ব্রিজ এবং স্টিলের উঁচু ভবন, কারখানা ও পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত হয়।
নিপ্পন এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আমদানি করা ইস্পাত, পুরলিন, স্লিটিং শীট এবং কয়েল থেকে এমএস প্লেট উৎপাদন করে। এছাড়াও এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এশিয়ান পেইন্টস গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রজ্ঞান কুমার বলেন, ‘আমরা আধুনিক কারখানা করেছি। ইতোমধ্যেই সেখানে পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে।
এদিকে পিএইচসি পাইলের প্রস্তুতকারক সমুদা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ৪ একর জমিতে কারখানা গড়ে তুলেছে। সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে ৮.২ মিলিয়ন ডলার। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল মেঘনা ইকোনমিক জোনে মেঘনা পিভিসি, সোনারগাঁ সোলার এনার্জি লিমিটেডের দুটি কারখানা উদ্বোধন করা হবে। একই এলাকায় মেঘনা গ্রুপের আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেঘনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫টি কারখানার বাণিজ্যিক উদ্বোধন হবে।
এগুলো হলো- মেঘনা ফয়েল প্যাকেজিং লিমিটেড, মেঘনা বাল্ক ব্যাগ লিমিটেড, সাকাতা ইনক্স (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড, সিগওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, টিআইসি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ পিটিওয়াই লিমিটেড। ২৫ একর জায়গায় মেঘনা পিভিসি লিমিটেড কারখানা করেছে। এখানে প্লাস্টিক কাঁচামাল, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) রেজিন এবং পলিথিন টেরেফথালেট (পিইটি) উৎপাদন হচ্ছে।
বেজা চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল (১টি জাপানি, ১টি চীনা এবং ২টি ভারতীয়) বাস্তাবায়ন কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছে। বাংলাদেশ স্পেশাল ইজেড লিমিটেড (জাপানিজ ইকোনমিক জোন) নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার প্রায় এক হাজার একর জমি ওপর। জাপানিজ ইকোনমিক জোনে ইতোমধ্যে শিল্প নির্মাণ শুরু করেছে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার।
বেজা আশা করছে এ জোনসমূহ বাস্তবায়িত হলে প্রস্তাবিত এলাকাসমূহ অত্যাধুনিক ব্যবসায়িক হাব হয়ে উঠবে যা দেশে দক্ষতা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কর্ণফুলি টানেল এবং চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে একটি কৌশলগত অবস্থানে স্থাপিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলটিও যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ শিল্পনগর ॥
চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও সীতাকু- এবং ফেনীর সোনাগাজী এলাকায় গড়ে উঠেছে এই শিল্পনগর। দেশের প্রথম বড় আকারের পরিকল্পিত শিল্পনগর হবে এটি। ৩০ হাজার একর নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অঞ্চলটি, যা হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগর। হাল্কা, মাঝারি ও ভারি পণ্য উৎপাদনের জন্য এই নগরটিকে আবার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে।
এই শিল্পনগরে ৫০০ একর ভূমিজুড়ে থাকবে বিজিএমইএ গার্মেন্ট ভিলেজ আর বেপজা ইকোনমিক অঞ্চলকে দেওয়া হয়েছে ১১শ একর জমি। দেশী-বিদেশী ১৪টি প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করেছে এখানে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে দেশী-বিদেশী যে বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, তার মধ্যে শুধু এ অঞ্চলেই এসেছে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রাথমিকভাবে প্রায় আট লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এখানে। তবে বেজার প্রত্যাশা, অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হবে এখানে। এতে ১৫ লাখ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
পর্যটনশিল্পের বিকাশেও থাকছে উদ্যোগ ॥ বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পে অবদান রাখতে বেজা কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপন কাজ শুরু করেছে। মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের নীল জলের পাশে গড়ে ওঠা সাবরাং ট্যুরিজম পার্কে ১৭ জন বিনিয়োগকারীকে ইতোমধ্যে প্রায় ৮১ একর জমি বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
এসব পার্কে পাঁচতারকা হোটেল, ইকো-ট্যুরিজম, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম, সি-ক্রুজ, ভাসমান জেটি, শিশু পার্ক, পানির তলদেশে রেস্টুরেন্ট, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, ঝুলন্ত সেতুসহ বিনোদনের নানা আকর্ষণীয় স্থাপনা থাকবে।
বিনিয়োগকারীর জন্য থাকছে নানা সুবিধা ॥ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে সরকার। ব্যবসা সম্পর্কিত বিভিন্ন কাগজপত্রের অনুমোদন ব্যবসায়ীরা বেজার মাধ্যমে পাচ্ছেন। তুলনামূলক কম দামে জমি বরাদ্দ, দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ, শিল্পবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ সুবিধা, ওয়ানস্টপ সার্ভিস (ওএসএস) থেকে বিভিন্ন সংস্থার ২৭ ধরনের ১২৫টি সেবা দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে ৪৮টি পরিষেবা অনলাইনে প্রদান করা হচ্ছে।
২০ হাজার দক্ষ জনবল তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে। যেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা দক্ষ জনবল পাবেন। বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন হারে আয়কর অব্যাহতি, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা, ভূমি উন্নয়ন কর অব্যাহতি, স্থানীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত কর, স্ট্যাম্প ডিউটি অব্যাহতি ও উৎসে কর অব্যাহতির পাশাপাশি বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা, কাস্টমস প্রক্রিয়ার সহজীকরণ সুবিধা দিচ্ছে সরকার।