ডেস্ক নিউজ
আর্থিক খাতে জালিয়াতি বন্ধ ও অর্থ লোপাটকারীদের শনাক্তে বহুমুখী তদারকি শুরু হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত ও বিশেষ তদন্তের পাশাপাশি প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো হবে। এর আওতায় এক ছাতার নিচে আসবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব লেনদেন। ফলে একটি বোতাম টিপেই মিলবে জালজালিয়াত বা অর্থ লুটেরাদের লেনদেনের সব তথ্য।
এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফরম (আইডিটিপি)। যেখানে এক আইডিতে (জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর) গ্রাহকের সব হিসাব ও লেনদেনের তথ্য থাকবে। কেন্দ্রীয় গেটওয়ে দিয়ে হবে সব লেনদেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ধরনের কাঠামো কার্যকর হলে অর্থনৈতিক অপরাধ রোধে যোগ করবে নতুন মাত্রা। লেনদেন সহজ হবে। নগদ টাকার পরিবর্তে গ্রাহকরা অনলাইন লেনদেনে উৎসাহিত হবেন। ভূমিকা রাখবে কাগজের মুদ্রাবিহীন সমাজ (ক্যাশলেস সোসাইটি) গঠনেও, যা উন্নত দেশগুলোয় ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এতে যুক্ত হলেও অক্টোবরের মধ্যে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর আওতায় আসবে। শুরুতেই যুক্ত হচ্ছে সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড এবং তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান রিকারশন ফিনটেক লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক, সিস্টেম এনালিস্ট ও উপপরিচালক পর্যায়ের তিন কর্মকর্তাও নিযুক্ত করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি সামনে রেখে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে ৫৪ কোটি ৯৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৯ টাকা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ব্যাংক আইডিটিপি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহুমুখী নজরদারির পরও বন্ধ হচ্ছে না অস্বাভাবিক লেনদেন। বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনে এসব চলছেই। নিয়ন্ত্রণে আসছে না অর্থ জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং।
জঙ্গি অর্থায়ন হচ্ছে, সাইবার অপরাধের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের অনিয়ম তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ তদারক সংস্থাগুলো। ফলে উন্নত বিশ্বের মতো কেন্দ্রীয়ভাবে একই সার্ভারে সব ধরনের লেনদেনের তথ্য না থাকার আক্ষেপ ছিল বহুদিনের। এবার সেই আক্ষেপের কিছুটা হলেও অবসান হতে যাচ্ছে। একই ছাতার নিচে আসছে সব ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি, মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর আওতায় পড়বে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্ল্যাটফরমের অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) ব্যবহার করবে ফিনটেক (ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি) প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সার্ভিসের আওতায় রেমিট্যান্স আদান-প্রদান, মার্চেন্ট পেমেন্ট, বিল পরিশোধ, ই-কমার্স, এম-কমার্স, মেশিন-টু-মেশিন পেমেন্টসহ অর্থ হস্তান্তর ও লেনদেন করা যাবে।
এটি মূলত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরদের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনে সেতুবন্ধ তৈরি করবে, যা একদিকে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনকে ত্বরান্বিত করবে, অন্যদিকে লেনদেনের যাবতীয় তথ্য একটি আইডিতে সংরক্ষিত থাকবে। ফলে একটি বোতাম টিপেই যে কোনো গ্রাহকের সব ধরনের হিসাব ও লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে সার্টের পরিচালক এবং আইডিটিপি প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট সমন্বয় ও পরীক্ষণ কমিটির সভাপতি তারেক এম বরকতউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ডিসেম্বরের আগেই প্রকল্পটি উদ্বোধন হবে। এ সময়ের মধ্যে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে আনা হবে। এটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে দেশ ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে এগিয়ে যাবে। মূল বিষয়টি হলো-এর মাধ্যমে একটি গেটওয়েতে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলে আসবে।
তিনি বলেন, যেহেতু একটি আইডির মাধ্যমে এখানে লেনদেন হবে, তাই যিনি অর্থ পাঠাবেন এবং যিনি গ্রহণ করবেন-প্রত্যেকের তথ্যই ওই আইডিতে থাকবে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের বিস্তারিত জানবে। কেউ যদি জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করে, তাহলে ব্যাংক সহজেই তা শনাক্ত করতে পারবে। জাতীয় পরিচয়পত্রটাই গ্রাহকের আইডি হিসাবে কাজ করবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ভিশনের মধ্যে অন্যতম একটি হলো ক্যাশলেস সোসাইটিতে চলে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। ফলে এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্যও সেটি।
বিজিডি ই-গভ সার্টের সিনিয়র টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট (ডিজিটাল সিকিউরিটি) তৌহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হবে, যা ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনে সহায়ক হবে। ডিজিটাল অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিনিময় যোগ্যতা, কম খরচ, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ডিআইজি মো. আবদুল্লাহেল বাকীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো অর্থনৈতিক অপরাধ নিয়ে কাজ করলে বিএফআইইউ-এর সহায়তা নিতে হয়। অনুরোধ করতে হয় অভিযুক্তদের লেনদেনের হিসাব সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য। তাদের কাছ থেকে তথ্য পেলে সেগুলো নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রত্যেকটি লেনদেন আলাদা আলাদা করে তদন্ত করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয়। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া বেশ জটিল। এই পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে খুব সহজেই তথ্য পাওয়া যাবে। তদন্তের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে।