করোনাকালে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ছিল কর্মহীন গরিবদের জন্য খাবার নিশ্চিত করা নিয়ে। শঙ্কা ছিল খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়েও। জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি বলেছিল, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় দুর্ভিক্ষ হতে পারে। অনাহারে প্রাণ হারাতে পারে প্রায় তিন কোটি মানুষ।
কিন্তু সুখবর হলো; করোনাকালেও দেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। আর দুঃসংবাদ হলো; মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদন করছেন, তারা ন্যায্যমূল্যে সেই পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। একই সঙ্গে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে পারছেন না ক্রেতারাও। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়ার পরও চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম চড়া। নিম্ন-মধ্যবিত্তের ক্রেতারা হিমশিম খাচ্ছেন।
চাল ও আলুর দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামের ধার ধারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ব সংস্থাগুলো খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নামও অন্তর্ভুক্ত করেছে। এমনই এক বিরূপ পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আজ শুক্রবার বিশ্বব্যাপী বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বিকশিত হোন, শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ’।
দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত থাকবেন।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জনবল সংকটের কারণে খাদ্য বিতরণ, সংগ্রহ, মনিটরিংসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য রাখার বিশেষায়িত কোনো হিমাগার নেই। ফলে কৃষক ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ ও বিক্রি করতে পারছেন না। এ সুযোগে বহু অসাধু মজুদদার কৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। করোনার কারণে শাকসবজি, মৌসুমি ফলসহ কৃষিপণ্যের স্বাভাবিক পরিবহন এবং সঠিক বিপণন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সময়মতো বিক্রি করতে পারছেন না, আবার বিক্রি করে ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না।
এ অবস্থায় প্রান্তিক কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, ভোক্তারা যাতে সহজে, স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে অনলাইনে কৃষিবাজার শক্তিশালী করার দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করতে কম শুল্ক্কে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্রিজারভ্যান আমদানির দাবি জানানো হয়েছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, কোনো দেশের খাদ্য পরিস্থিতি শুধু উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এর সঙ্গে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে যেহেতু বিশ্বব্যাপী একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজমান, সে কারণে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারকে দক্ষতা ও সক্ষমতা দেখাতে হবে। এখন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন এবং মজুদে হয়তো সমস্যা নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলার সাফল্য নির্ভর করবে বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত থাকার ওপর। মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, করোনাকালেও দেশে ভালো উৎপাদন হয়েছে। ধান উৎপাদনে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। এর পরও খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকার সব সময় সচেতন। দেশে খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, চাহিদা অনুযায়ী সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে দেশে প্রথম উন্মুক্ত কৃষিবাজার ‘ফুড ফর ন্যাশন’ চালু করা হয়েছে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জনবলও বৃদ্ধি করা হবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান বলেন, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য উৎপাদিত পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক করতে হবে। পরিবহন, জনবল, হিমাগার ও অনলাইন বাজরের সংকট দূর করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সংকট নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ, মূল্য নির্ধারণ করা হলেও বাজার মনিটরিং করার জন্য সরকারের সক্ষমতা নেই। শুধু খাদ্য উৎপাদন করলেই হবে না। বরং খাদ্যের সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।
জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে খাদ্য কার্যক্রম :দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকটে ভুগছে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলো। বর্তমানে খাদ্য অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে প্রায় সাত হাজার পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিপুল সংখ্যাক পদ শূন্য আছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ৮৬৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ৪৩১টি পদই শূন্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শূন্য পদ আছে সাত হাজার ২২৬টি। এতে খাদ্য বিতরণ, সংগ্রহ, মনিটরিংসহ সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। একই সঙ্গে ভেজালবিরোধী অভিযান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সমকালকে বলেন, জনবল সংকট দূর করার জন্য গত ২০ মার্চ নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের কারণে এই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিগগির এ পরীক্ষা নেওয়া হবে। এ ছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট বিধান মেনে নিয়োগ দিতে হয়। এ জন্য তাড়াহুড়া করা যায় না। তিনি বলেন, চাকরিপ্রার্থীরা যাতে কোনো দালালের খপ্পরে না পড়েন এ জন্য বিশেষ উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, অধিদপ্তরের অধিকাংশ পদই শূন্য। অথচ বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জনবলের খুবই প্রয়োজন। কৃষি বিপণনের কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ ও পদ সৃজন করা দরকার। দুই হাজার ৩২৫টি পদ সৃজনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও অনুমোদন হয়নি।
খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ :সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে চার কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার টন হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন, গম ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন, ভুট্টা সাত লাখ ৩০ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে তিন কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার টন বা ২৪ শতাংশ বেশি, গম ১২ লাখ ৪৬ হাজার টন বা ৪৭ শতাংশ বেশি, ভুট্টা ৫৪ লাখ দুই হাজার টন উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন- আলু ৫২ দশমিক ৬৮ লাখ টন থেকে ১০৯ দশমিক ১৮ লাখ টন, ডাল ১ দশমিক ৯৬ থেকে ১০ দশমিক ৪৯ লাখ টন, তেলবীজ ৬ দশমিক ৬১ থেকে ১১ দশমিক ৫৪ লাখ টন, শাকসবজি ২৯ দশমিক ৯ থেকে ১৮৪ দশমিক ৪৮ লাখ টন এবং পেঁয়াজ ৭ দশমিক ৩৬ থেকে ২৫ দশমিক ৫৭ লাখ টন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। কিন্তু মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি। ১৬ কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন কাজ। কারণ এটি স্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সে কারণে সাধারণ মানুষ, উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারীর মধ্যে উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিপণন নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ জন্য কৃষিপণ্যের মূল্য ও মজুদ নিয়ে কারসাজি, অন্যায়ভাবে বাজারকে প্রভাবিত করা, কৃত্রিম সংকট তৈরি করা- এ ধরনের কোনো অব্যবস্থাপনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক হতে হবে।