ডেস্ক নিউজ
পটুয়াখালীর লেবুখালী নদীতে পায়রা সেতুর কাজ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের চূড়ান্ত রূপের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসী। চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই যানবাহন চলাচলের মাধ্যমে জনসাধারণের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হতে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলকে সারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সমানতালে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদী। খরস্রোতা এ নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১২ সালে ৮ মে পায়রা সেতুর জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের একটি উন্নয়ন প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়। ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা কুয়েত ফান্ড থেকে ৩৩৬ কোটি ২৬ লাখ এবং সরকারের নিজস্ব ৭৭ কোটি ৩ লাখ। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী সফরকালে লেবুখালী নদীর পাড়ে পায়রা সেতুর ভিক্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরবর্তিতে বিভিন্ন জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় ২০১৫ সালে প্রাক্কলন বাড়িয়ে ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল কুয়েত ফান্ড ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (কেএফএইডি) ও ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) এর যৌথ অর্থায়নে ১১৭০ .০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিন রোড অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে পূর্তকাজ শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় এক্সট্রা ডোজড ক্যাবল স্টেইড ১৪৭০ মিটার দীর্ঘ, চার লেন বিশিষ্ট ফুটপাথসহ ১৯.৭৬ মিটার প্রশস্থতা সম্পন্ন ব্রিজটির কাজ শুরু হয়। মূল সেতুর ৪টি স্প্যানসহ মোট ৩২টি স্প্যানের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩০টি স্প্যান নির্মাণ শেষ হয়েছে। সবচেয়ে দীর্ঘতম ২০০ মিটার স্প্যান ও ১৩০ মিটার পাইলের গভীরতা সম্পন্ন ভায়াডাক্ট সেতুর ২৬৬টি পাইল এবং ২৬টি পাইলক্যাপের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে মূল সেতুর সুপার স্ট্রাকচার বক্স-গার্ডার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে এবং সুপার স্ট্রাকচারের ৬৩০ মিটার বক্স-গার্ডারের মধ্যে ৬১৭ মিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও সেতুর পটুয়াখালী ও বরিশাল প্রান্তের সংযোগ সড়কের কাজ চলমান।
পায়রা সেতু প্রকল্পের উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক কামরুল হাসান জানান, বর্তমানে পায়রা সেতুর মূল ১৪৭০ মিটারের মধ্যে মাত্র ১১ মিটার অংশ সংযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। যা চলতি মাস বা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সংযুক্তির মাধ্যমেই স্বপ্নের পায়রা সেতু একপ্রান্ত অপর প্রান্তের সাথে যুক্ত হয়ে সারা দেশের সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের আওতায় চলে আসবে।
খরস্রোতা পায়রা নদীর ভাঙন থেকে নদীতীর রক্ষা কাজের জন্য হাইড্রোলজিক্যাল স্ট্যাডি সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে সিসি বøক ও জিওব্যাগের ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে কাজ চলমান রয়েছে। চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যে সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পর চলমান ফেরিঘাটের নদী শাসনের কাজ শেষ করা হবে। ইতোমধ্যে নদী শাসনের কাজ ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হালিম।
তিনি আরো জানান, প্রথমবারের মত কোন সেতুতে ব্রিজ স্ট্রাকচারাল হেলথ মনিটরিং সিস্টেম চালুসহ ভূমিকম্প নিরোধক যন্ত্রাদি সংযোজন করা হচ্ছে। এছাড়াও সেতু সংলগ্ন নদীর পাড়ে সুন্দর একটি দৃষ্টিনন্দন পার্কের ব্যবস্থায় করা হবে। এ সেতুর মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ১৪৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৬৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা সরকারের, এছাড়াও কুয়েতের ১০৭৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২২ থাকলেও সেতু কর্তৃপক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চলতি বছরের জুলাই মাসের মধ্যে মূল সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তারা প্রকল্পের অন্যান্য কাজও সমাপ্ত করে ফেলবেন। ইতোমধ্যে মূল সেতুর ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
পায়রা সেতুর নির্মাণ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সাথে সারা দেশের নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগে একধাপ এগিয়ে যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম একদিকে যেমন বাড়বে, তেমনি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাকে ঘিরে দেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া এ অঞ্চলের উৎপাদিত দ্রব্যাদি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন ও বাজারজাতকরণে সহজতর হবে। যা এ অঞ্চলের জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
এদিকে সরকারের পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষের পথে রয়েছে। পায়রা সেতু চালুর মাধ্যমে বন্দর থেকে খালাসকৃত যে কোন পণ্য খুবই কম সময়ের মধ্যে সারাদেশে পরিবহন করা যাবে। পায়রা সেতুর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হবে পাশাপাশি এ অঞ্চলে নতুন নতুন বিনিয়োগে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন হবে। পাশাপশি জাতীয় অর্থনীতিতে সাফল্যজনক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
পটুয়াখালী চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, লেবুখালীতে পায়রা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলে এ অঞ্চলের সাথে সারাদেশের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। ইতোমধ্যে চলমান মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন করে ইপিজেড করার কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসছে যা এক সময়ের অবহেলিত পটুয়াখালীকে সম্ভাবনার পটুয়াখালীতে রুপান্তরিত করবে। পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।