ডেস্ক নিউজ
প্রত্যাশার চেয়েও বেশি-বিদেশি ঋণসহায়তা আসায় ব্যাংক থেকে খুব একটা ঋণ নিতে হচ্ছে না সরকারকে। আর এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে, যা দেশের অর্থনীতিকে করোনা মহামারির আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাক্ষিক তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য ধরা আছে। যেভাবে বিদেশি ঋণসহায়তা আসছে, সেটা অব্যাহত থাকলে আর রাজস্ব আদায়ের ইতিবাচক ধারা চলমান থাকলে গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে অনেক কম ঋণ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ও অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। গতি এসেছে অর্থনীতিতে; আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রপ্তানি। রাজস্ব আদায়েও মোটামুখি ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সবচেয়ে স্বস্তি এনে দিয়েছে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ঋণ সহায়তা। সে কারণেই মহামারির এই কঠিন সময়েও অর্থ সঙ্কটে পড়েনি সরকার; ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়নি খুব একটা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ অন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে স্বাভাবিক গতিতে।
সাত মাসেই প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই (জুলাই-জানুয়ারি) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪৬৯ কোটি (৪.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) এই অর্থের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া এই ঋণসহায়তা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। এর আগে সাত মাসে এত বেশি বিদেশি ঋণসহায়তা কখনও পায়নি বাংলাদেশ।
রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১৬.১২ শতাংশ
করোনা মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি।
সেই ইতিবাচক ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।
ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাহিদা ছিল বেশ কম। শুরুর দিকে সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, পরিশোধ করেছিল তার চেয়ে বেশি। তবে শেষ দিকে গিয়ে নিট ঋণ দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
যদিও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে রেকর্ড ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা নিয়েছিল সরকার।
সঞ্চয়পত্র থেকেও কম ঋণ এবার
কড়াকড়ি আরোপ ও সুদের হার কমানোয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সে কারণে এ খাত থেকেও সরকারের ঋণ কমে গেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঋণের অঙ্ক ছিল দ্বিগুণেরও বেশি ২৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
আট মাস ধরে বাড়ছে বেসরকারি খাতে ঋণ
দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। টানা আট মাস ধরে বাড়ছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক; জানুয়ারিতে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছে। ফিরে গেছে মহামারির আগের অবস্থায়।
করোনা মহামারির ধাক্কায় কমতে কমতে গত বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি একেবারে তলানিতে, ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে জানুয়ারিতে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছে।
তবে এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে রয়ে গেছে এই সূচক।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ।
স্বস্তিতে সরকার
সংকটের সময়ে বেশি ঋণ পেয়ে খুশি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যি বলতে কি, আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করোনার টিকা খাতে ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মেটাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে দ্রুত ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি তাদের ভালোভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। তারা দ্রুত সাড়া দিয়েছে; এখনও দিচ্ছে। সে কারণে করোনার ধাক্কা সামলে খুব দ্রুতই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি; যা বিশ্বের অনেক দেশই পারেনি।’
বিদেশি ঋণের এই গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন শামসুল আলম।
তিনি বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার জন্যও মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়া গেছে। এখনও পাওয়া যাচ্ছে; ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
‘এই ঋণসহায়তা এবং আমাদের সরকারের দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব যতটা পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি।’
শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি করোনার আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। রপ্তানি-আমদানিসহ অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো। সব মিলিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা মহামারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছি।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণ কোভিড মোকাবিলায় সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। পরপর দুই বছর ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফরেন এইড অবাক করার মতো; চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
‘এই কঠিন সময়েও সরকারকে কোনো ধরনের অর্থসংকটে পড়তে হয়নি। উন্নয়নকাজ থেমে থাকেনি; টিকা কিনতে সমস্যা হয়নি।’
এসব কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করছেন আহসান মনসুর।
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নেওয়ার সুফল পাচ্ছে বেসরকারি খাত। জানুয়ারিতে দেখলাম বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। টানা আট মাস ধরে বাড়ছে এই প্রবৃদ্ধি। এর ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। বিনিয়োগ বাড়বে; কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।’