ডেস্ক নিউজ
যে সংবাদ-মাধ্যমটি কয়েক যুগ ধরে আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, সেই বিবিসির বাংলা সংস্করণ চালুর পর কেন যেন মনে হয়, সেই ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটেছে! বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ বা সজীব ওয়াজেদকে নিয়ে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের পর বিবিসি বাংলার সম্পাদক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক সাবির মুস্তাফা নিজেই লিখেছিলেন, “একটি জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার যে, আমরা খবরটা যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে তৈরি করি নাই।”
সম্প্রতি বাবরি মসজিদ ইস্যুতে আগুনে ঘি ঢালার মতো বাংলাদেশের দাঙ্গা সম্পর্কিত ১৯৯২ সালের খবর প্রচার দেখে অনেকেই বিস্মিত ও হতাশ হয়েছিলেন! গত ৭ এপ্রিল মানবিক কারণে ব্যক্তি উদ্যোগে আমদানি করা করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগকালীন প্রতিবেদকের আরও অনেক দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে ৫০ হাজার করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট আমদানি করেছেন। প্রয়োজনে আরও আনা হবে বলেও জানান তিনি। এগুলো বিভিন্ন হাসপাতালে দেয়া হয়েছে এবং ডাক্তারদের পরামর্শ মোতাবেক পরীক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের চলমান সঙ্কটে মানবিক কারণে আমদানিকৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম হয়তো অন্যান্য দেশের মতোই পরিপূর্ণভাবে সকল শর্ত পূরণ করেনি, কিন্তু অলাভজনক এই উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অপ্রত্যাশিত!
বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদন মোতাবেক আপত্তির কারণ হচ্ছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত র্যাপিড টেস্ট কিটের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভুল ফলাফল আসার যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, সেটি উল্লেখ করে আমদানিকৃত পিসিআর সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বিবিসি প্রকাশিত একটি সংবাদে লেখা হয়েছে, “কোভিড নাইন্টিনের পরীক্ষার খরচ, প্রয়োজনীয় যন্ত্র যোগাড় আর সময়ের সাথে তাল মিলানো বড় চ্যালেঞ্জ। পিসিআর বা ডায়াগনোস্টিক পদ্ধতির টেস্ট হওয়ায় এর ফল আসতে যেমন সময় লাগে তেমনি কিটও ব্যয়বহুল।” সূত্র: https://www.bbc.com/bengali/news-52174095
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি পরীক্ষার কিট বাজারে আনার চেষ্টা করছে বলেও বিবিসি প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে না কেন – এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বিবিসি’তে। এটা কি পরস্পরবিরোধী অবস্থান নয়? সূত্র: https://www.bbc.com/bengali/news-52170597
জাহাঙ্গীর আলম পিসিআর আমদানি করতে সিটি কর্পোরেশনের কোনো টাকা খরচ করেননি। তিনি চিকিৎসা সরঞ্জাম বা স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত নন। র্যাপিড টেস্ট কিট ছাড়াও পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) আমদানি করেছেন তিনি। এর উদ্দেশ্য মোটেও বাণিজ্যিক বা আর্থিক নয়। এছাড়া ওষুধ প্রশাসন ও আমদানি সংশ্লিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে প্রায় ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। বিশ্বজুড়ে যখন মহামারি চলছে, তখন সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে মানবসেবার জন্য পিসিআর আমদানি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতটা অবিবেচনাপ্রসূত তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
অন্যান্য দেশের চিত্র
যুক্তরাজ্যের Harley Street Clinic ছাড়াও কয়েকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট আমদানি করছে। করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার জন্য রোগীকে ব্যয় করতে হয় প্রায় ৪০০ পাউন্ড। চীনের এই কিট ইউরোপ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি ও ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যান্য দেশে বেসরকারি পর্যায়ের পরীক্ষার খরচ অন্তত তিনগুণ বেশি। সূত্র: https://www.theguardian.com/world/2020/mar/13/harley-street-clinic-offering-375-coronavirus-private-test
করোনা ভাইরাস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য স্টার্ট-আপ কোম্পানিও গড়ে উঠেছে এবং সরকারি বা বেসরকারি, কোনো পর্যায় থেকেই এ ধরণের উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। সূত্র: https://fortune.com/2020/03/23/everlywell-home-coronavirus-testing-kit/
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এ জাতীয় উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। সূত্র: https://hbr.org/2020/03/what-the-u-s-needs-to-do-right-now-to-fight-coronavirus
প্রশ্ন উঠতে পারে পরীক্ষা নির্ভুল হবে কিনা! মূলত নির্ভুল পরীক্ষা শুধু কিটের ওপর নির্ভর করে না। বেশিরভাগ টেস্টিং কিটের মাধ্যমে লক্ষণ বিবেচনা করে, অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা বা ওষুধ কোনোটিরই চূড়ান্ত কোনো মাত্রা নির্ধারণ করা যায়নি। করোনাভাইরাস শনাক্ত করার কার্যকর পদ্ধতির জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। তাই অন্যান্য রোগের সঙ্গে করোনার তুলনা করে মাপকাঠি নির্ধারণ করা বাস্তবতা বিবর্জিত।
গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের আমদানিকৃত কিটগুলো চীনে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া করোনা পজিটিভ হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসিডিডিআর,বি’তে পুনরায় পরীক্ষা করা হয়। বেসরকারিভাবে স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই এ জাতীয় পদক্ষেপ বা উদ্যোগের প্রশংসা না হোক, কিন্তু সমালোচনা করা জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।
বাংলাদেশে এক সময় সংবাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হতো বিবিসিকে। রেডিওতে বিবিসির সংবাদ শোনার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করত! মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করে বিপুল জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল বিবিসি। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতাই ছিল বিবিসির প্রতি সকলের আকর্ষণের মূল কারণ। কিন্তু বিবিসির বাংলা সংস্করণ চালুর পর, অনেক সংবাদ দেখলে মনে হয় যেন নয়াদিগন্ত বা আমার দেশ পত্রিকার সংবাদ পড়ছি। প্রায় ৮০ বছর ধরে বিবিসি বস্তুনিষ্ঠতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে এই প্রত্যাশা সকলের।