ডেস্ক নিউজ
বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম এড়াতে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমার নামাজ সাময়িকভাবে স্থগিত করে ফতোয়া দিয়েছেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ।
গত ১৭ মার্চ রিয়াদে সৌদি কাউন্সিল অব সিনিয়র স্কলারস (সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ) এর ২৫তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই অধিবেশনে তারা করোনা ভাইরাস, এর দ্রুত বিস্তার এবং ব্যাপক প্রাণহানির বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। পাশাপাশি তারা এই মহামারী সংক্রান্ত বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য মেডিক্যাল রিপোর্টও খতিয়ে দেখেন।
সৌদি আরবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে মহামারীর দ্রুত সংক্রমণ ও ভয়াবহতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন: এটি মানুষের জীবনের জন্য বিরাট হুমকি। সুতরাং এ বিষয়ে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে ঝুঁকি বহুগুণ বাড়বে।
গণজমায়েত করোনা সংক্রমণের প্রধান কারণ বলেও তিনি ওই অধিবেশনে উল্লেখ করেন।
এমন প্রেক্ষাপটে অধিবেশনে সিনিয়র স্কলারগণ মানুষের জীবন রক্ষার অপরিহার্যতা সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করেন।
এরমধ্যে রয়েছে:
কোরআন শরীফের ১৯৫ নাম্বার আয়াত। ওই আয়াতে আল্লাহ আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَة
‘এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সূরা বাকারা: ১৯৫)
সূরা নিসার ২৯ নাম্বার আয়াতও তারা পর্যালোচনা করেন।
وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
‘এবং নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।’
কোরআনের এ দু’টি আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জীবন নাশের কারণগুলো থেকে বেঁচে থাকা ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য)। ওই সভায় তারা এমনই সিদ্ধান্তে আসেন।
এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিম্নোক্ত হাদিসগুলো দ্বারা মহামারী বিস্তৃতি লাভের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। যেমন- হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন:
لا يُورِد ممرض على مصح- متفق عليه
“কোন ব্যক্তি যেন তার অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের কাছে না নিয়ে যায়।” (বুখারি ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন: فر من المجذوم كما تفر من الأسد -أخرجه البخاري
“কুষ্ঠরোগী থেকে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করো।” (সহিহ বুখারী)।
রাসুল (সা.) আরও বলেন: إذا سمعتم الطاعون بأرض فلا تدخلوها وإذا وقع بأرض وأنتم فيها فلا تخرجوا منها- متفق عليه.
“যদি কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনো তবে সেখানে যেও না। আর যদি কোন এলাকায় তোমাদের থাকা অবস্থায় মহামারী সৃষ্টি হয় তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না।” (বুখারি ও মুসলিম)
বিজ্ঞাপন
সৌদি স্কলাররা বলেন: ইসলামী শরিয়তের একটি মূলনীতি হলো, لا ضرر ولا ضرار
“নিজের অথবা অন্যের কোনও ক্ষতি করা যাবে না।”
শরিয়তের আরেকটি মূলনীতি হলো: أن الضرر يدفع قدر الإمكان
“যতটা সম্ভব ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিহত করতে হবে।”
উপরোক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে তারা বলেন: (বিশেষ প্রয়োজনে) মসজিদে সকল ফরজ এবং জুমার সালাত বন্ধ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কেবল আজান দেয়াই যথেষ্ট। তবে হারামাইন তথা মক্কা ও মদিনার দুই মসজিদ এর আওতামুক্ত থাকবে। যদিও পরবর্তীতে তা বন্ধ করা হয়েছে।
ওই অধিবেশনে বলা হয়: মসজিদের দরজা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। এসময় মসজিদগুলোতে আজান চালু থাকবে। আর আজানে বলা হবে: صلوا في بيوتكم
“সাল্লূ ফী বুয়ূতিকুম।”
“আপনার বাড়িতেই সালাত আদায় করুন।”
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে যে: রাসূল (সা.) তাঁর মুয়াজ্জিনকে আজানে এ কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়, জুমার দিন বাড়িতেই জোহরের চার রাকআত সালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহর একটি অনুগ্রহ যে, ওজরের কারণে কেউ যদি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও জুমার সালাত জামাতে আদায় করতে সক্ষম না হয় তবুও তাকে তার পূর্ণ সওয়াব দান করা হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: إذا مرض العبد أو سافر كتب له مثل ما كان يعمل مقيماً صحيحاً
“বান্দা যদি অসুস্থ হয় অথবা সফরে যায় তাহলে সে সুস্থ ও আবাস অবস্থায় যে আমল করত মহান আল্লাহ তাকে তার সমপরিমাণ সওয়াব দান করেন।” (সহিহ বুখারি)
ওলামা পরিষদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রতিরোধ ও সতর্কতামূলক নির্দেশনাগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার এবং তাদেরকে সহযোগিতার করার জন্য সকলকে উপদেশ দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ
“এবং তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না।” (সূরা মায়িদা: ২)
এ সকল পদক্ষেপ ও নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা মূলত সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতির কাজে সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে আমাদের সুমহান দ্বীন আমাদেরকে আল্লাহর উপর ভরসা করার পর পার্থিব উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার যে নির্দেশ দিয়েছে এটি তা বাস্তবায়নের শামিল।
পাশাপাশি আল্লাহকে ভয় করা, অধিকহারে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিনীতভাবে দোয়া করার জন্য সবাইকে উপদেশ দেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ।
আল্লাহ বলেন: وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُمْ
“(হুদ আলাইহিস সালাম বললেন) হে আমার সম্প্রদায়, তোমারা তোমাদের পালনকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার কাছে তওবা কর। তিনি তোমাদেরকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি দিবেন এবং তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন।” (সূরা হুদ: ৫২)
এখানে ‘শক্তি’ কথাটির মধ্যে জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা, সার্বিক নিরাপত্তা এবং সর্ব প্রকার সুস্থতা ও বিপদাপদ থেকে মুক্তির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।
ওলামা পরিষদ বলেন: আমরা মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তিনি যেন তাঁর বান্দাদের থেকে এ মহাবিপদ উঠিয়ে নেন এবং খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন, আমাদের সরকারকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারীর প্রতিরোধে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ ও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় উত্তম বিনিময় দান করেন। আরও দুআ করি, তিনি যেন সকলকে হেফাজত করেন।
فَاللَّهُ خَيْرٌ حَافِظًا وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
“কারণ আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ হেফাজত কারী ও সর্বাধিক দয়াশীল।” (সূরা ইউসুফ: ৫৪)