বাংলাদেশের কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর ও হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা সামনে আসার পর ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে ঢাকার সঙ্গে কথা বলতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
পার্লামেন্টে কংগ্রেসের দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে এই ধরনের ঘটনার প্রভাব সীমান্তের এপারেও পড়তে পারে। সেজন্য তারা চান বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে উত্থাপন করা হোক।
এই ঘটনায় ভারত এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়নি ঠিকই, তবে ক্ষমতাসীন বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে কুমিল্লার ঘটনার ব্যাপারে ভালভাবে খোঁজ নিয়ে তার পরই সরকার মন্তব্য করবে।
বাংলাদেশের কুমিল্লাতে রবিবার বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগের খবর ভারতে ছড়িয়ে পড়তেই সে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় বিরোধী দল কংগ্রেস।
লোকসভায় তাদের দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বিবৃতি দিয়ে বিষয়টিতে ভারত সরকারকে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।
ভারত সরকারের কাছ থেকে এখানে তারা ঠিক কী ধরনের ভূমিকা প্রত্যাশা করছেন?
সে প্রশ্নের জবাবে মি চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, “ব্যাপারটা হলো প্রতিবেশী দেশে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে সেই দেশকে একটু ‘নক’ করার দরকার হয়।”
“তাদেরকে বলতে হয় যে আপনাদের ওখানে এই সব ঘটছে বলে খবর আসছে, ওগুলো ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থা নিন। দোষীদের গ্রেপ্তার করুন, যাতে পরিস্থিতি আরও এসক্যালেট না করে।”
“নইলে এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ ফুলেফেঁপে বাড়তেই থাকে, আর সেটার ‘স্পিল ওভার এফেক্ট’ এপারেও আমরা টের পাই।”
“বিশেষ করে আমরা যারা সীমান্ত অঞ্চলে থাকি, আমার কেন্দ্রের অন্য দিকেই রাজশাহী বর্ডার – আমাদেরকে এসব ব্যাপারে একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয়।”
“তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী মরশুম প্রায় এসেই গেছে, এই সময়টায় এ ধরনের খবর নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর জল্পনা, গুজব ছড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয়ে থাকে”, বলছিলেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী।
সেই আশঙ্কাগুলো বিলীন করতেই বিষয়টা অঙ্কুরে বিনাশ করা দরকার, বলছে কংগ্রেস।
তবে কুমিল্লার ঘটনার ব্যাপারে ভালভাবে খোঁজ না নিয়ে ভারতের পক্ষে কোনও মন্তব্য করা কঠিন বলেই মনে করছে শাসক দল বিজেপি।
বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র তথা এমপি অপরাজিতা সারঙ্গী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “কেন সেখানে ওই হামলার ঘটনা ঘটল ভারত সরকারকে আগে সেটা ভাল করে খতিয়ে দেখতে হবে।”
“কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে সেটা জানার পর নিশ্চয় ভারত ব্যবস্থা নেবে, বাংলাদেশ সরকারের কাছেও বিষয়টা তোলা হবে। কিন্তু ঘটনার পূর্বাপর না-জেনেই কীভাবে মন্তব্য করা সম্ভব?”
“একই সঙ্গে বলবো, বিশ্বের যে কোনও জায়গায় হিন্দু বা ভারতীয়দের ওপর হামলা আমরা কখনওই মেনে নেব না। সেই প্রশ্নে কখনওই আমরা আপস করব না!”, জানাচ্ছেন মিস সারঙ্গী।
রিপাবলিক টিভি, টাইমস নাও-সহ ভারতের বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী টিভি চ্যানেল কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এর মধ্যেই উচ্চকিত – তারা একে ইসলামী মৌলবাদ হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছে।
বছর সাতেক আগেও যখন বিজেপি বিরোধী দলে ছিল, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিজেপি ছিল বেশ সরব।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখন ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের নানা কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে।
তাছাড়া ঢাকাতেও এখন রয়েছে একটি বন্ধু সরকার, ফলে কুমিল্লার ঘটনা নিয়ে বিজেপি সেভাবে মুখ খুলছে না।
এই অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের নেতা অনির্বাণ গাঙ্গুলি।
মি. গাঙ্গুলি বিবিসিকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে যেটা মনে হচ্ছে, ফ্রান্সের ঘটনার প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় যে ধরনের বিক্ষোভ দেখিয়েছে তার অভিঘাতেই হয়তো কুমিল্লার ঘটনা ঘটেছে।”
“হিন্দুরা সংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশের একটি দুর্বল ও ভালনারেবল জনগোষ্ঠী, তাই তাদের ওপরই এই ধরনের হামলা বারবার হয়।”
“কংগ্রেসকে আমি বলতে চাই, এ ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যা করার ঠিকই করবে এবং যথাযথ চ্যানেলে বিষয়টি তোলাও হবে। ঢাকায় আমাদের হাই কমিশনার খুবই সক্রিয়, তিনিও নিশ্চয় বিষয়টা দেখবেন।”
“তবে কংগ্রেসের সঙ্গেও তো দলগতভাবে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক আছে, তারাও বিষয়টা বাংলাদেশের সঙ্গে তুলুন না? কংগ্রেসের দলনেতা হিসেবে অধীর বাবুর সরাসরি কথা বলতেই বা বাধা কোথায়?”
“আসলে বিজেপি ক্ষমতাতেই থাকুক বা বিরোধী দলে, বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব সময় সরব থেকেছে। কিন্তু কংগ্রেস বরাবরই এ বিষয়টায় নীরব”, পাল্টা অভিযোগ মি. গাঙ্গুলির।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যে কিছুতেই ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না, সেটা অবশ্য মানেন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও।
তিনি বলছিলেন, “যেদিন থেকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছেন, সে দিন থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে সোনালি অধ্যায় শুরু হয়েছে। আমরাও চাই প্রতিবেশীদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক থাকুক – বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে।”
“তার সবচেয়ে বড় কারণ, পশ্চিম সীমান্তে ইতোমধ্যেই আমাদের শত্রু প্রতিবেশী আছে – পূর্ব সীমান্তের প্রতিবেশীকেও চটিয়ে ফেললে সেটা হবে খুবই বিপজ্জনক!”
আর এই বাস্তবতাই যে বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের সবশেষ ঘটনা নিয়ে ভারতকে আপাতত সংযত থাকতে বাধ্য করেছে – তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।