ডেস্ক নিউজ
করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যেও থেমে নেই গুজব। সম্প্রতি নতুন এক গুজবে শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছে ভারত। যেখানে মালদ্বীপ ও কুয়েত এর মত দেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে নিজ দেশে কেন অন্য দেশের সেনাবাহিনী সহায়তার জন্য প্রয়োজন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না কেউ। এই গুজব সৃষ্টিকারী এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সহায়তা কার্যক্রমে দারুণ খুশি কুয়েত। দেশটির নিউজ চ্যানেলসমূহে ফলাও করে প্রচার করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন অসাধারণ কাজের কথা। কুয়েতে দু’টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার পরিচালিত করছেন বাংলাদেশি সেনা চিকিৎসকরা। তাদের কর্মদক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার গল্পও সেখানকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
ঠিক একইভাবে মালদ্বীপে নিজেদের সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। করোনার থাবায় আক্রান্ত দেশটির ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স’র চীফ অব ডিফেন্স ফোর্স মেজর জেনারেল আবদুল্লাহ সামাল দিন কয়েক আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে মেডিকেলসহ আনুষঙ্গিক সহায়তার জন্য লিখিতভাবে অনুরোধ জানান। সেনাপ্রধান বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের অনুরোধের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। বন্ধু রাষ্ট্রের আহ্বানে তাৎক্ষণিক সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতটা দক্ষ হলে এভাবে সহায়তার অনুরোধ জানানো হয় তা যে কেউ কল্পনা করতে পারবেন সহজে। বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধ, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা সামগ্রী পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও নৌ বাহিনীর জাহাজে করে ৮৫ টন খাদ্য সামগ্রী গত বুধবার (১৫ এপ্রিল) পৌঁছে দেওয়া হয়। বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের দৃষ্টান্ত থেমে নেই এখানে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের কাছে অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মালদ্বীপে চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যের মেডিকেল টিম পাঠানো হয়।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় ২০ এপ্রিল বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ জে পরিবহন বিমানে বাংলাদেশ ও নেপালে অবস্থানরত মালদ্বীপের ৭১ জন নাগরিককেও দেশটিতে পৌঁছে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই সহায়তা কার্যক্রমে খুশি হয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর তড়িৎ সিদ্ধান্তে এই সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা হওয়ায় ২২ এপ্রিল মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মুহাম্মদ সলিহ টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
কিন্তু বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কখনো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই দক্ষতার ওপর ভরসা করে কিছু প্রচার করছে না এই গুজব রটনাকারীরা। আর এ কারণেই তাদের লক্ষ্য যে দেশকে নেতিবাচক দিকে ঠেলে দেয়া তা বেশ সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। বিশ্বের বুকে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরণের উদ্যোগ প্রশংসার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে, তখন দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অর্জনকে ম্লান করে দিতেই একটি মহল ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশে অন্য দেশের সেনা সহায়তার কথা প্রচার করছে বলে জানায় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর দল পাঠাচ্ছে ভারত।’-এমন একটি খবর প্রচার হবার পর অনেকেই তার সত্যতা যাচাই না করেই শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এদের অধিকাংশই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে শেয়ার দিলেও আসলে সকলে মিলে একটি গুজবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই সহায়তা করেছে। কোন তথ্য দেখে ক্ষোভ জানিয়ে তা প্রচারের আগেও বিষয়টি যাচাই বাছাই করে দেখা উচিত বলে এর আগেও মত দিয়েছেন খোদ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। কিন্তু অধিকাংশ দেশের ব্যবহারকারী বিষয়টি মানছেন না।
এদিকে এই খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছে কোন মেডিকেল সহায়তা চায়নি বাংলাদেশ। ভারত সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে এবং ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক নষ্ট করতে এমন একটি খবর প্রচার করা হয়। এ ছাড়াও দেশে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্জনকে ম্লান করে দেয়ার একটি অপচেষ্টা হিসেবেও বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে।
ভিত্তিহীন এই গুজবের বিষয়ে বেশ স্পষ্ট করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীই অন্য দু’টি দেশকে সহায়তা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য আসছে এমন কোনো তথ্যও আমার জানা নেই।’
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভয়-শঙ্কা ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে জাতিগত বিরোধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পিছিয়ে পড়া দেশসমূহে সাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই করে নিয়েছেন লাল-সবুজের দেশের গর্বিত সেনা সদস্যরা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের নির্দেশে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান, সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে দেশের ৬২ টি জেলাতেই মাঠে নেমেছেন সেনা সদস্যরা। এ ছাড়াও লকডাউনের কারণে খাদ্য কষ্টে থাকা মানুষকে নিজেদের অর্থায়নে সহায়তা করছেন সেনা সদস্যরা।
করোনা মহামারী থেকে দেশকে রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পর্যাপ্ত চিকিৎসক, মেডিকেল কোর ও পর্যাপ্ত মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছে। সক্ষমতা রয়েছে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরিরও। আছে নিজস্ব ৫ টি মোবাইল হাসপাতাল। এছাড়া প্রয়োজনে ৩ ঘণ্টার মধ্যে যে কোন জায়গায় ৫০ বেডের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠারও সক্ষমতা আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর।
বিশ্লেষকদের মতে, সক্ষমতায় বিশ্ব ব্যাপী উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার করোনা মোকাবেলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছে আদতে এমন ভুল সংবাদের নুন্যতম কোন ভিত্তি নেই।
দেশ গুজব নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় প্রতিনিয়তই এর বিস্তার ঘটছে বলেই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ‘সব খবরই নির্ভরযোগ্য নয়, সেটা বুঝতে হবে। টেলিভিশন কিংবা বিশ্বস্ত নিউজ পোর্টাল থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে তা ফেসবুকে ছড়ানো যাবে না। গুজব প্রতিরোধে আমাদের এই কাজগুলো গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে।’