ডেস্ক নিউজ
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা
- বিরামহীন কাজ করছেন ৪ হাজার শ্রমিক
- দুই পাশে খাল, সার্ভিস রোড
- ৬/৭ মিনিটে সাড়ে ১২ কিলোমিটার রাস্তা পার
- একসঙ্গে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন ৪০ হাজার পর্যটক
- আগামী ডিসেম্বরেই নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা
আজাদ সুলায়মান ॥ রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভার পয়েন্ট থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার রাস্তাটি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় এক্সপ্রেসওয়ে। পূর্ব-পশ্চিমে যোগাযোগের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের পাশাপাশি এটি হবে দেশের অন্যতম পর্যটন স্থাপনা। সেভাবেই চলছে ১৪ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ। ৮ লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে থাকছে এক শ’ ফুট দৃষ্টিনন্দন খাল এবং সার্ভিস রোড। এই অত্যাধুনিক এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে না কোন ধরনের স্টপওভার পয়েন্ট, সিগন্যালিং সাইন কিংবা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা। ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের যানবাহন চলবে আপন গতিতে। কারোর সঙ্গে কোন কন্টাক্ট হওয়ার সুযোগ নেই। এর নির্মাণ কাজ শেষ হলে একটি গাড়ি ৬/৭ মিনিটে বাধাহীনভাবে পার হবে সাড়ে ১২ কিলোমিটার পথ। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পে বর্তমানে দিনরাত চলছে কর্মযজ্ঞ। করোনা মহামারী কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়ও থেমে নেই কাজের গতি। ৪ হাজার শ্রমিক বিরামহীন কাজ করে চলেছেন। সুবিশাল ক্রেন, লিফটার, ট্রাক ড্রেজার এস্কাভেটর ইক্যুইমেন্ট নিয়ে যে প্রযুক্তিতে কাজ করা হচ্ছে তাতে নজর কাড়ে যে কোন পথিকেরই। প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মঈন উদ্দিন জানালেন, এটা হবে হাতিরঝিলের চেয়েও আরও অত্যাধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন। এটা শুধু ঢাকার পূর্ব-পশ্চিমের নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগেরই জন্য নয়। পাশাপাাশি এতে থাকছে সৌন্দর্যের ফোয়ারা ও বিনোদনের মনোমুগ্ধকর সব নিদর্শন।
জানা গেছে, কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত মূল রাস্তাটি হবে ৮ লেনের। দুই পাশে এক শ’ ফুট করে দুটি খাল। দুটি খালেরই দুই পাশে থাকছে সার্ভিস রোড। সার্ভিস রোডেও থাকবে একাধিক লেন। তার বাইরেও থাকছে বিভিন্ন আবাসিক এলাকা থেকে যুক্ত হওয়ার জন্য গেটওয়ে। ওই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, বর্তমানে কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত যে কটা সেতু রয়েছে, প্রত্যেকটি সেতুর পাশেই আবার সম্প্রসারিত সেতু নির্মাণ করতে হচ্ছে যাতে রাস্তার প্রশস্ততা না কমে। পূর্ব পশ্চিমে কিংবা পশ্চিম পূর্ব যে দিক থেকেই চলাচল করা হোক, এক্সপ্রেসওয়েতে থামাথামির কোন সুযোগ নেই। ননস্টপ রানিং বলতে যা বুঝায় সেটাই থাকছে এখানে। এজন্য রাখা হয়েছে ৫টি অলগ্রেড ইন্টারসেকশন। যাতে দ্রুতযানগুলো স্পিড না কমিয়ে লেন পরিবর্তন করে অবিরাম চলতে পারে।
মূল লেন তৈরি ছাড়াও সংস্কার হবে ডুমনি, বোয়ালিয়া ও এডি-৮ খাল। কুড়িল থেকে বালু নদ পর্যন্ত হবে ৮ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে। দুই পাশে থাকবে সার্ভিস লেন। বালু থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে। নির্মাণ করা হবে ১০টি বড় সেতু। হাতিরঝিলের আদলে ১৩টি আর্চ ব্রিজ। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ৪ কিলোমিটার নালা, দুটি কালভার্ট, ১২টি ওয়াটার বাসস্ট্যান্ড। থাকবে ৪টি পাতাল পথ। ২০১৫ সালের মূল প্রকল্পে উল্লেখ থাকা পদচারী সেতুর সংখ্যা ৪টি থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১২টি। পাম্প হাউস ১টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি, সøুইসগেট ৪টি থেকে বাড়িয়ে ১০টি করা হয়েছে। খাল পারাপারে দৃর্ষ্টিনন্দন পদচারী ব্রিজগুলো মূলত পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। ব্রিজে উঠে উপভোগ করতে পারবেন গোটা প্রকল্পের সৌন্দর্র্য। দুই পাশের খালে চলবে ওয়াটার বাস, যা মূলত পর্যটকদের জন্যই চালু করা হবে। খালের দুই পাশে তৈরি করা হবে সবুজ ওয়াকওয়ে। এক সঙ্গে ৪০ হাজারের বেশি পর্যটক উপভোগ করতে পারবেন প্রকল্পের সৌন্দর্য।
রাজউকের আবাসন প্রকল্পের বাইরে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এটি মূলত ২০১৫ সালে পাস হওয়া ‘কুড়িল-পূর্বাচল লিঙ্ক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের সংশোধিত রূপ। ২০১৫ সালে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৫ হাজার ২৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর সঙ্গে আরও তিনটি খাল, সড়ক, সেতুসহ আনুষঙ্গিক বিষয় যুক্ত হওয়ায় সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৪২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। সেটা আরও কয়েক দফা বেড়ে হয়ে গেছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকায়।
রাজউক সূত্রমতে, মূলত রাজধানীর পশ্চিম পূর্ব যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পশ্চিমের জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি সমধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ প্রকল্পে। সংশোধিত প্রকল্পে তিনটি খাল যুক্ত করা হয়েছে। খাল তিনটি হয়ে গেলে নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২, জোয়ারসাহারা, সেনানিবাস, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুর, কাওলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না। প্রথমে বর্ষা মৌসুমে নিকুঞ্জ, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, জোয়ারসাহারা, সেনানিবাস, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুর, কাওলা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ১০০ ফুট খালটি খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বাস্তবে শুধু ১০০ ফুট খাল দিয়ে বিশাল এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়। তাই প্রকল্পের সঙ্গে নতুন করে ডুমনি, বোয়ালিয়া ও এডি-৮ খাল তিনটি যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে হোটেল লা মেরিডিয়ানের পেছনের এডি-৮ খালের সঙ্গে যুক্ত বোয়ালিয়া খাল। খাল দুটির বড় অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নতুন করে খাল দুটি খনন করা হবে। খননের পর বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হবে ১০০ ফুট খাল। খননের পর এডি-৮ খালের দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ১ কিলোমিটার এবং বোয়ালিয়া খালের দৈর্ঘ্য হবে ৫ দশমিক ২ কিলোমিটার। দুটি খালেরই প্রস্থ হবে ১০০ ফুট করে। এই দুই খালের পানি ১০০ ফুট খাল হয়ে বালু নদে গিয়ে পড়বে। এ ছাড়া ডুমনি এলাকার ডুমনি খালটিও সংস্কার করা হবে। এই খালটিও প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। খননের পর এই খালেরও প্রস্থ হবে ১০০ ফুট, দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এই খালটি পাশের কাঁঠালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে ডুমনি খালের পানিও বালু নদ পর্যন্ত যাবে। এর বাইরে পাড় বাঁধাইসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে।
বহুল প্রতীক্ষিত এ প্রকল্পটির তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে রাজউক। এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাজউকের প্রকৌশলী এম এম এহসান জামিল। জনকণ্ঠকে তিনি জানালেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অপারেশনাল কাজ চলছে। এ ধরনের একটি অভূতপূর্ব এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করার জন্য সেনাবাহিনী দেশে কয়েকটি শীর্ষ বেসরকারী নির্মাণ কোম্পানিকে সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে নিয়োজিত করে। এগুলো হচ্ছে এনডিই, বিশ্বাস বিল্ডার্স, এআরকে, এ্যাডভান্স স্ট্রাকচারসহ অন্তত ডজনখানেক কোম্পানি। এরা নিজ নিজ ভাগের কার্য সম্পাদন করছে। ইতোমধ্যে বেশ দক্ষতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নিজের কার্যাদেশে প্রাপ্ত কাজটুকু প্রায় সমাপ্তির পথে। অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এনডিই। বাকিদের কাজও চলছে বেশ সন্তোষজনক গতিতে। প্রকল্প পরিচালক এমএম এহসান জামিল ও ব্রিগেডিয়ার মঈন জানালেন, এখন পর্যন্ত সব কিছু স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে চলছে। এ পর্যন্ত ৭০ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। আগামী ডিসেম্বর অর্থাৎ শুকনো মৌসুমেই বাকি কাজ সম্পন্ন করে উদ্বোধন করা যেতে পারে। সরকার যদি অর্থ ছাড়ের গতি ঠিক রাখতে পারে তবে ডিসেম্বরেই দেশবাসী এর সুফল পাবেন।
জানা গেছে, প্রকল্পটিতে সেনাবাহিনীর নিজস্ব চৌকস জনবল ও প্রযুক্তির পাশাপাশি আউট সোর্সিং করা হয়েছে বেসরকারী কয়েকটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে চলছে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ। যা বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে রাজধানীর পুর্ব পশ্চিমের যোগাযোগের দীর্ঘদিনের বিড়ম্বনা। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক হিসেবে এটি শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় এক্সপ্রেসওয়ের মর্যাদা পাবে।
২০১০ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত ড্যাপ প্রকল্পে কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত দুটি ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল রাখা হয়। ইতোমধ্যে খাল দুটি কাটা শেষ হয়েছে। বর্তমানে এই খাল দুটি যথাযথভাবে কাজ করছে না। ফলে বর্ষাকালে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বারিধারা, ক্যান্টনমেন্ট এবং বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা রয়েই গেছে। এ কারণে কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘পূর্বাচল লিঙ্ক রোডের উভয় পাশে ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খনন ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রথমবার একনেকে অনুমোদিত হয়। তখন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ১৪৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় হতে বিশেষ সংশোধনী এনে ব্যয় বাড়ানো হয় কয়েক ধাপে। পুনর্গঠিত প্রকল্প ব্যয় ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ধরে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের টার্গেট ধরা হয়। বহুল আকাক্সিক্ষত এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৪৫ দশমিক ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। মাটি খনন, কাদা মাটি অপসারণ ও মাটি ভরাট করা হয়েছে প্রয়োজন মতো। স্লুইস গেটও নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় থাকছে আরবরিকালচার, আর্চ ব্রিজ, কালভার্ট, আন্ডারপাস নির্মাণসহ নিকুঞ্জ লেক উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন।
একাধিক ধাপে প্রকল্পটির সম্প্রসারণ অনুমোদন করায় ব্যয়ও বেড়েছে। প্রথমে ৫ হাজার ২৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এটি অনুমোদিত প্রকল্পভুক্ত কাজ বালু নদী অতিক্রম করে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয় এবং প্রকল্পভুক্ত কাজের পরিধি বাড়ানো হয়। সঙ্গে নতুন নতুন রাস্তা ও খাল খনন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়াও সংলগ্ন ৩০০ ফুট প্রশস্ত সড়কটিকে এক্সপ্রেসওয়ে আকারে ৮ লেনে সম্প্রসারণ, ৬ লেন করে সার্ভিস রোড নির্মাণ, নতুন করে অতিরিক্ত ২২০ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ, পাম্প হাউস নির্মাণ, ডাইক বাঁধ স্থাপন ইত্যাদি কারণে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে যায়। কয়েক ধাপে প্রকল্প সংশোধন শেষে চূড়ান্ত ব্যয় দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। জানা গেছে, প্রকল্পের ব্যয় আরও কিছুটা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।