ডেস্ক নিউজ
ঈদুল আজহা উপলক্ষে পর্যটন শহর কুয়াকাটায় তিন তারকা হোটেল সিকদার রিসোর্টের সব ভিলা এবং কক্ষ আট দিনের জন্য বুকিং হয়ে গেছে। এখনও প্রতিদিন বুকিংয়ের জন্য বহু পর্যটক ফোন করলেও তাঁদের ‘সরি’ বলছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবারের ঈদে ঢাকা এবং আশপাশের জেলার পর্যটকদের বুকিং বেশি হয়েছে এই হোটেলে। হোটেল কুয়াকাটা গ্র্যান্ডের বিভিন্ন মানের ৪৪টি কক্ষের সবই ৯ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত বুকড। তাঁদের হোটেলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর্যটকদের বুকিং বেশি এসেছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ঈদুল ফিতরের চেয়ে এবার দ্বিগুণ পর্যটক আসবেন কুয়াকাটায়। তাঁদের ধারণা, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর প্রথম ঈদে এখানে অর্ধলাখ পর্যটক আসবেন। বহুমুখী এ সেতুর প্রভাবে সমৃদ্ধ হবে কুয়াকাটার পর্যটন শিল্প।
প্রাকৃতিক রূপ-লাবণ্যে ঘেরা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। এ জন্য এই সৈকত নিয়ে পর্যটকদের আলাদা আগ্রহ আছে। লাল কাঁকড়ারচর, গঙ্গামতী, রাখাইনপল্লি, ফাতরার বন, শুঁটকিপল্লি ও চরবিজয়ের মতো অর্ধশত পর্যটন স্পটের টানে পর্যটকরা বারবার ছুটে আসেন কুয়াকাটায়। বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তি মাথায় নিয়ে পর্যটকরা কুয়াকাটায় আসতেন সাগর ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এখন অবস্থা বদলেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানী ঢাকা থেকে কুয়াকাটা আসতে কোনো ফেরির ভোগান্তি নেই। একসময় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা আসতে ৯টি ফেরি পারের ঝক্কি নিতে হতো। তাতে সময় ব্যয় হতো ১০-১২ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু হয়ে এখন ৬ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসছেন পর্যটকরা। ফলে এখন থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিপুলসংখ্যক পর্যটক কুয়াকাটায় আসবেন বলে আশাবাদী স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এবারের ঈদুল আজহায় পর্যটকের ঢল নামবে বলে তাঁদের প্রত্যাশা।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি জানিয়েছে, এখানে তিন তারকা মানের তিন-চারটি হোটেলসহ বিভিন্ন মানের হোটেল-রিসোর্ট আছে প্রায় ১৫০টি। এতে সর্বোচ্চ ১৫-২০ হাজার পর্যটকের আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। তাই এবার বাড়তি পর্যটকদের আবাসন
সেবা দিতে তাঁরা ‘কমিউনিটি ট্যুরিজম’ চালু করবেন। এর আওতায় বাড়তি পর্যটকদের কুয়াকাটা পৌর শহরের ৩০০ বাসাবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবেন।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম হাওলাদার বলেন, তাঁদের সমিতির ৭০টি হোটেলের প্রতিটিতে ঈদ-পরবর্তী তিন-চার দিনের বুকিং হয়ে গেছে। এখন আর কোনো হোটেলে বুকিং নেওয়া হচ্ছে না। বাড়তি পর্যটকদের আবাসন সুবিধা দিতে তাঁদের হিমশিম খেতে হবে।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, পদ্মা সেতু কুয়াকাটার ভাগ্য খুলে দিয়েছে। কুয়াকাটাকে শতভাগ পর্যটনবান্ধব হিসেবে তুলে ধরতে তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (কুটুম) সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, তাঁদের সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড, ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতি, বাইকার ও ফটোগ্রাফারদের নিয়ে সভা করেছেন। তাঁদের পর্যটনবান্ধব মানসিকতা নিয়ে সেবা দিতে বলা হয়েছে।
দেশি আর সামুদ্রিক খাবার :কুয়াকাটা খাবার হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম মুন্সী বলেন, তাঁদের সমিতির আওতায় কুয়াকাটায় ২৫টি খাবার হোটেল আছে। এ ছাড়া আছে অভিজাত তিন-চারটি রেস্তোরাঁ। কিছু ভাসমান খাবার হোটেলও আছে। তাঁদের সমিতিভুক্ত হোটেলগুলো ঈদের বাড়তি পর্যটকদের মানসম্মত খাবার পরিবেশন করতে প্রস্তুত রয়েছে। সেলিম মুন্সী বলেন, তাঁর ‘খাবার ঘর’ হোটেলে শুক্রবার থেকে তিনি পাঁচ ধরনের শুঁটকি ভর্তা করবেন। রান্না করবেন সামুদ্রিক টুনা, লাক্ষ্যা, মেদ, কোরাল, তাইরাল, রূপসা ও চাকা চিংড়ি মাছ। থাকবে দেশি মুরগি এবং গরু ও খাসির মাংস।
কুয়াকাটা ইলিশ পার্ক রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী রুমন ইমতিয়াজ তুষার জানান, তাঁর পার্ক রেস্তোরাঁয় ঈদুল আজহায় পর্যটকদের সেবা দিতে চালের রুটি-হাঁসের মাংস, রাখাইন ফুড, সী ফুডসহ নানা ধরনের আয়োজন থাকবে।
সুসজ্জিত হচ্ছে ট্যুরিস্ট বোট :পূর্ব-পশ্চিমে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নয়নাভিরাম কুয়াকাটা সৈকতের চারপাশে আছে প্রায় ২৫টি ট্যুরিস্ট স্পট। এসব স্পটে যেতে হয় নদী ও সাগরপথে। এ জন্য কুয়াকাটায় ট্যুরিস্ট বোট ব্যবসা এখন জমজমাট। ঈদে পর্যটকদের নৌ ও সাগরপথে ভ্রমণ করাতে নবরূপে সজ্জিত করা হচ্ছে বোটগুলো। কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমিতির সভাপতি জনি আলমগীর বলেন, বর্ষা মৌসুমে ফাতরার বন, লাল কাঁকড়ারচর, শুঁটকিপল্লি ও ফকিরহাট স্পটে যাওয়া সম্ভব হয়। ঈদে এই চারটি স্পটে পর্যটকদের ভ্রমণে নেওয়ার জন্য সমিতির সব বোট নতুন করে রং ও মেশিন মেরামত করা হচ্ছে। ঈদে বোট মালিকরা ৩০ ভাগ ছাড় দেবেন। জনপ্রতি ৫০০ টাকার স্থলে নেবেন ৩৫০ টাকা।
অব্যবস্থাপনা :পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুয়াকাটায় প্রতিদিন দূরপাল্লার বাস আসছে ৫০-৬০টি। এ ছাড়া আসে পর্যটকবাহী শতাধিক মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার। কিন্তু কুয়াকাটায় নেই বাস টার্মিনাল। দুই-তৃতীয়াংশ হোটেলে পার্কিং সুবিধা নেই। এ কারণে দূরপাল্লার এবং অভ্যন্তরীণ রুটের বাস ও অন্যান্য যানবাহন সড়কের ওপর এবং সৈকত-সংলগ্ন জিরো পয়েন্টে পার্ক করা হয়। এতে কুয়াকাটার প্রধান সড়কে যানজট লেগেই থাকে। ফলে পর্যটকদের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হয়। সৈকতের ব্যবসায়ীরা আবর্জনা ফেলে সৈকত নোংরা করে রাখেন। কুয়াকাটায় ২০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন একজন। ঈদে পর্যটকদের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ নেই। ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটে বিরক্ত হন পর্যটকরা। সৈকতে নেই আলোর ব্যবস্থা।
তবে পর্যটকদের ভ্রমণ নিরাপদ করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়ে কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, ঈদের আগের দিন থেকে কুয়াকাটায় অতিরিক্ত অর্ধশত ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন করা হবে। যেসব স্পটে পর্যটক বেশি যাতায়াত করেন, সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী জলযান সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। পর্যটকরা ঈদের ছুটিতে কোনো রকম সংকটে পড়বেন না কুয়াকাটায়।