ডেস্ক নিউজ
বাংলাদেশ জন্মের শুরু থেকেই দেশের কূটনীতিকরা সাফল্য দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্ধারণ করা ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ পররাষ্ট্রের এই নীতি গত ৫০ বছরে কূটনীতিকরা সাফল্যের সঙ্গে ধরে রেখেছেন। যে কারণে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পথ পাড়ি দিয়ে উন্নত দেশের কাতারে যোগ দিতে এগিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক একাধিক ফোরামে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিশে^ শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত ৫০ বছরে কূটনীতিতে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে, ব্যর্থতাও আছে, তবে সফলতার পাল্লাই ভারী।
গত ৫০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের কূটনীতির প্রথম পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল। ওইদিন ভারতের কলকাতায় তৎকালীন পাকিস্তানের উপ-হাইকমিশনার এম হোসেন আলিসহ মিশনের সব বাঙালি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে এবং ওই মিশনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান, যা বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মূলত এ ঘটনার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের কূটনীতি সাফল্যের সঙ্গে যাত্রা শুরু করে।
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকের শুরুতেই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি আদায় চ্যালেঞ্জ ছিল, যে পরীক্ষায় বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায় উৎরে গেছে ঢাকা। চীন আর সৌদি আরব ছাড়া ওই সময় বিশে^র সব দেশের পাশাপাশি একাধিক বৈশি^ক সংস্থা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সম্পর্ক গড়ে তোলে।
ওই সময়কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করা ভারতীয় সেনাসদস্যদের তিন মাসের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতার কারণে। পাশাপাশি একই সময়ে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার লাহোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল। এ ঘটনার পরই মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সহজ হয় এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার পথ সুগম হয়।
তিনি আরও বলেন, ওই সময়ের ব্যর্থতা ছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সন্তোষজনক বৈশি^ক সহযোগিতা না পাওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পুরো বিষয়টিই ছিল একটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য। তখনকার মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তিনি যেভাবে কমনওয়েলথ এবং নন-এলাইন মুভমেন্ট, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি এবং জাতিসংঘে তিনি ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে বিশে^ প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা নজিরবিহীন।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের আমল পর্যন্ত বাংলাদেশের কূটনীতিকরা কার্যত তাদের কাজ করতে পারেননি। এ সময়টা সামরিক মোড়কে রাজনীতি নামে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য কূটনীতিকদের ব্যবহার করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশ উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের কূটনীতি যে বেগে চলছিল তা বাধা পায়।
সাবেক সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, তখন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ দেশের ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু ওই অভ্যুত্থানের কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব ৯ বছরের শাসনামলে দিতে পারেননি এইচএম এরশাদ। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অবস্থান ছিল বেশ দুর্বল। এরশাদ সরকারের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা এ সময়ে কূটনীতিকদের অন্যতম প্রধান কাজে পরিণত হয়। যে কারণে ওই সময়ে দেশের স্বার্থে কূটনীতিকদের দৃঢ় অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসকের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেশের কূটনৈতিক তৎপরতাও যেন প্রাণ ফিরে পায়। দেশের স্বার্থ বজায় রাখতে কূটনীতিকদের কাজ করার সুযোগ মিলে।
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, এ সময়ে বহিঃবাণিজ্য ও অভিবাসন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পরিণত হয় প্রথম বা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী দেশে; যা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে সুরাহা হয়।
এ সময়টা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, নব্বইয়ের দশকে এবং ২০০০-এর শুরুর দিকটাতে তখনকার গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে বিএনপি সেই ঐতিহাসিক দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। এ সময়ে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে দরকষাকষির জায়গা থেকেও দেশ অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কিছুটা দরকষাকষির জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের কূটনীতিতে সবচেয়ে সাফল্যের সময়টা হচ্ছে গত ১৩ বছরের (২০০৯ থেকে বর্তমান)। এই সময়ে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ কওে; যা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। এ সময়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন (এমডিজি) করে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বিরোধসহ একাধিক অমীমাংসিত ইস্যুর নিষ্পত্তি করে, একাধিক বৈশি^ক ফোরামে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে, চীন-জাপানসহ একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হয়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, এ সময়টায় সাফল্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনীতি বেশ কিছু হতাশা আর সমস্যাও মোকাবিলা করেছে। কেননা এ সময়ে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিবাচক পদক্ষেপের কোনো দৃশ্যমান প্রতিদান দেয়নি ভারত। সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি এবং পানি বণ্টনের স্থায়ী সুরাহা এখনও হয়নি। অন্যদিকে ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং আসামের নাগরিক পঞ্জি উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বাংলাদেশের উন্নয়নে, দাতা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কটাকে একটা শক্তিশালী পর্যায়ে নেওয়ার পুনঃচেষ্টা করে। এখন বাংলাদেশে বহুপাক্ষিক দাতাগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আছে, আর দ্বিপাক্ষিক দাতা দেশ হিসেবে জাপান বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিচ্ছে। এখন আমরা দাতা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হলেও পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমেছে। কারণ আগে উন্নয়ন বাজেটের ৯০ শতাংশ নির্ভর করতে হতো দাতা দেশগুলোর ওপর, এখন তা কমে ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে; যা ইতিবাচক।