ডেস্ক নিউজ
ধান গাছের সবুজ গালিচায় ছেয়ে গেছে উত্তরাঞ্চল। এরই মাঝে এক খণ্ড জমিতে পাকা সোনালি ধান। শরতের শুভ্র আকাশের নিচে বাতাসে দোল খাচ্ছে ধানের শীষ। অসময়ে মাঠে পাকা ধানে কৌতূহলের শেষ নেই কৃষকের। এ চমক দেখিয়েছেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ভীমপুর গ্রামের কৃষক রেজওয়ানুল হক। তিনি চলতি বছর ২১ জুলাই বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি বিনা ধান-১৬ এক একর জমিতে রোপণ করেছিলেন। এর আগে ১০ একর জমিতে ১৪ জুলাই বিনা ধান-১৭ রোপণ করেছিলেন। চলতি অক্টোবরে তিনি ধান কাটা শুরু করেছেন। ভালো ফলনের পাশাপাশি উচ্চ মূল্যে খড়ও বিক্রি করছেন। বছরে চারটি ফসল আবাদের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাকে দেখে আশপাশের কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এ ধান আবাদে।
রেজওয়ানুল হক বলেন, আমাদের এলাকায় গতানুগতিক জাতের আমন ধান আবাদ হয়। তাই চারদিকে সবুজের মাঝে শুধু আমার ক্ষেতটিই সোনালি। এখনও বেশিরভাগ জমির ধান গাছে শীষই বের হয়নি, অথচ আমার ধান পেকে গেছে। আমি সেটি ঘরেও তুলে নিচ্ছি। বিনা-১৬ ও বিনা-১৭ ধানের ফলন ভালো। এতে আমন-আগাম আলু-নাবি আলু-আউশ কিংবা আমন-সরিষা-বোরো অথবা আমন-আলু-সবজি এমনকি আমন-আলুর সঙ্গে সাথী ফসল মিষ্টিকুমড়া, বোরো অথবা আউশ করা সম্ভব। এতে ফসল উৎপাদন বেশি হবে, আয়ও বাড়বে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) রংপুর উপকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, বিনা উদ্ভাবিত বিনা ধান-৭ উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা নিরসনে অভূতপূর্ব সাফল্য এনেছে। মরা কার্তিকে পাকা আমন ধানে ভরা মাঠ কৃষকদের উপহার দিয়েছিল বিনা ধান-৭। বর্তমানে দেশে ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে আমন মৌসুমে উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনবিশিষ্ট বিনা ধান-১৬ ও ১৭ উদ্ভাবন করে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। বিনা ধান-১৬-এর জীবনকাল মাত্র ৯৫ থেকে ১শ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ টন অথবা বিঘাপ্রতি ২৪ মণের বেশি। বিনা ধান-১৭ এর জীবনকাল ১১০ থেকে ১১৫ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৬ টন অথবা বিঘাপ্রতি ২৭ মণের বেশি।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, আমাদের লক্ষ্য ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো। একজন কৃষক যেন বছরব্যাপী ফসল আবাদ করে বেশি মুনাফা পায়। প্রচলিত জাতে আমন ধানের জীবনকাল ১৬০ থেকে ১৭০ দিন। আমরা সেটি কমিয়ে ১শ থেকে ১০৫ দিনে নিয়ে এসেছি। এতে উত্তরাঞ্চলে যে মঙ্গা, দূর্ভিক্ষ ছিল; মানুষ খাবার পেত না; শ্রমিকরা কাজ পেত না; সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমরা ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করতে পারব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আমাদের দেশে বোরো ধানের উৎপাদন কমাতে চায় না কৃষক। ফলে দেশে ডাল ও তেল ফসলের অনেক ঘাটতি রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ কোটি টাকার তেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। স্বল্পমেয়াদি বিনা-১৬ ও বিনা-১৭ ধান কৃষকরা আবাদ করলে তারা বোরোসহ অনায়াসে ডাল ও সরিষা আবাদ করতে পারবে। এতে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা) কমলারঞ্জন দাশ বলেন, ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির সঙ্গে মাটির ওপর চাপ পড়ছে। মাটির গুণাগুণ বজায় রেখে তৈরি করা শস্য বিন্যাস কৃষকদের মাঝে প্রদর্শনীর মাধ্যমে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। আমাদের শিক্ষিত কৃষকরা বাণিজ্যিক কৃষিতে এগিয়ে এসে কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মেসবাহুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিনা-১৬ ও বিনা-১৭ জাতের ধান স্বল্পমেয়াদি ও উচ্চফলনশীল হওয়ায় কৃষকরা বছরে ৪টি ফসল করতে পারছে। ফলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া আশ্বিনে কৃষকের গোলায় ধান উঠছে, শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে। আগাম আলু করে অনেক বেশি আয় করতে পারছে কৃষক। ফসলের নিবিড়তা বাড়ার কারণে আমাদের দেশে কৃষি অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। বছরে ৪টি ফসল উৎপাদনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ সময়মতো ফসল কাটা ও রোপণ করা। আমরা সনাতনি ব্যবস্থা থেকে সরে এসে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে বিনা ধান-১৬ ও বিনা ধান-১৭ জাত কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণে তারাগঞ্জের ভীমপুরে আলোচনা সভা হয়েছে। এতে অনলাইনে যুক্ত হয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক দেশ থেকে মঙ্গা শব্দটি তুলে দেওয়ার কথা জানান। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, তারাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান লিটন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, বিনা রংপুর উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলীসহ কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।