ডেস্ক নিউজ
এ বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে গরু, ছাগল ও ভেড়া মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু। রাজধানীর হাটে বেচাকেনা এখনো শুরু না হলেও এরই মধ্যে রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা-গ্রামাঞ্চলে ব্যবসায়ী ও খামারি-গৃহস্থদের মধ্যে গবাদি পশু কয়েক দফা হাত বদল হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তার পাশাপাশি সরকারিভাবে অনলাইন পস্ন্যাটফর্মেও কোরবানির পশু বিক্রি জমে উঠেছে। এ ছাড়াও চামড়া, মসলা, দা, বঁটি, পরিবহণ, পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বেড়েছে রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ)। শহর থেকে টাকা যাচ্ছে গ্রামে। সব মিলিয়ে কোরবানির অর্থনীতিতে জিডিপি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। তবে এর নেতিবাচক দিক হিসেবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, কোরবানির ঈদ ঘিরে বাজারে টাকার প্রবাহ কয়েক গুণ বেড়েছে। বিশাল অঙ্কের টাকা শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছে। বণ্টন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এতে অধিকাংশ মানুষের কাছেই টাকা পৌঁছে গেছে। ফলশ্রম্নতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। অথচ সঠিক ছকে এই অর্থের প্রভাব কাজে লাগানো গেলে দেশের জিডিপি আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ডক্টর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, ‘এলোমেলোভাবে কোরবানির সময় বিশাল অঙ্কের টাকা দেশের বাজারে মুভমেন্ট করে। এর সঠিক হিসাব রাখা খুবই কঠিন। তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত করা গেলে তা জিডিপিকে আরও সমৃদ্ধ করবে। একইসঙ্গে সরকারের রাজস্ব ভান্ডারও সমৃদ্ধ হবে।’ বাজার পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদরা জানান, প্রতি বছর দেশে কোরবানির আগে ও পরে সপ্তাহব্যাপী বিচ্ছিন্নভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। সঠিক পরিকল্পনা ও হিসাব না রাখার কারণে এই লেনদেন থেকে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে তা দেশের অর্থনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদিও এক্ষেত্রে চামড়া ব্যবসায়ের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য এবং অনেকেই মনে করেন, কোরবানি মানে কেবলই চামড়ার বাণিজ্য, যা আদৌ সঠিক নয়। কোরবানির সময় শুধু চামড়ার বাণিজ্যই হচ্ছে না, একইসঙ্গে গরু জবাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি-বঁটি-দা’র ব্যবসা রয়েছে। গরুকে খাওয়ানোর খড়, ভুসির দেদার বেচাকেনা হয়। জবাইয়ের সময় পাটের চট, বাঁশের চাটাই এগুলোর দরকার হয়। আর মাংসের জন্য মসলার বিপুল ব্যবসায়ের সঙ্গে আছে মাংস সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ব্যবসায়ও। এর সঙ্গে গরু আনা-নেওয়া, বেচাকেনায় সহায়তা এবং জবাই ও মাংস তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমের বিনিময় মূল্যও উলেস্নখযোগ্য। সব মিলিয়ে একটি বিরাট অঙ্কের টাকা এই এক সপ্তাহে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। এই বড় অঙ্কের অর্থনীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং গতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে অর্থনীতির পালে সুবাতাস দিয়ে এর প্রত্যেকটি খাত বা সেক্টরকে গতিশীল করে তোলা সম্ভব। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে মুদ্রা সরবরাহ, লেনদেন ও আর্থিক কর্মকান্ডের যে প্রসার ঘটে সাধারণত তাকেই আয় বলা হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ, ২০২১ সালে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। চলতি বছর ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮টি পশুর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি। গরু-মহিষের এ সংখ্যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গবাদিপশু রয়েছে ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩টি আর গৃহপালিত গবাদিপশুর সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৯০। ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭, যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪০ আর গৃহপালিত গবাদি ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪১ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৭। এছাড়া উট, দুম্বা ও অন্যান্য পশুর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি। কোরবানির পশুর একটি বড় অংশ কেনা হয় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত গৃহস্থের কাছ থেকে, যারা কোরবানি উপলক্ষে এই পশুগুলো লালন-পালন করেন। এতে তাদের অর্থনীতির চাকা সচল হয়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলো সচল হয়ে ওঠে। তাছাড়াও কোরবানির পশু পরিবহণ, টোল, বকশিশ, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবারেও লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে, চলতি বছর ৪০ লাখ গরু-মহিষ কোরবানি হলে প্রত্যেকটি চামড়ার মূল্য গড়ে এক হাজার টাকা ধরলেও এর মূল্য হবে ৪০০ কোটি টাকা। আবার ৩০ লাখ ছাগলের প্রত্যেকটির চামড়ার মূল্য ২০০ টাকা ধরলেও এ বাবদ হয় ৬০ কোটি টাকা। গরু এবং ছাগলের চামড়া মিলিয়ে এই পুরো টাকা চলে যাচ্ছে সরাসরি গরিবদের হাতে। বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। কোরবানির ওপর ভর করেই টিকে আছে বিপুল সম্ভাবনার এ খাতটি। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কোরবানি ঈদে। এছাড়া কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। কোরবানি উপলক্ষে লবণের ব্যবসাও চাঙা হয়। চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনবলের। তখন শ্রমিকরা পান তাদের শ্রমের চড়ামূল্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ লোকের সাময়িক কর্মসংস্থান তৈরি হয়। প্রতি বছর দেশে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজ, ৭ লাখ টন রসুন আর ৪ লাখ টন আদার চাহিদা থাকে। এর উলেস্নখযোগ্য অংশই ব্যবহার হয় কোরবানিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩২ হাজার ৪৫৩টি পরিবারে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৯৩ জন সদস্যের জীবিকা নির্বাহ হয় কামার পেশার মাধ্যমে। কামার পণ্যের ব্যবসায়ী ও কামাররাও অপেক্ষায় থাকেন ঈদুল আজহার। রাজধানীর কামারশালাগুলোতে এ সময় ২ থেকে ৫ লাখ টাকার মতো বিক্রি আদেশ আসে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব মিলিয়ে কোরবানিতে এসব পণ্যের বাজার ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, গত ঈদুল ফিতরের অর্থনীতি প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার মতো ছিল। সেখানে ঈদুল আজহায় ওই অর্থের সঙ্গে আরো প্রায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হবে। সব মিলে এবার ঈদে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে বাড়তি প্রায় দুই লাখ কোটি টাকাম যা গ্রামীণ ও শহরের অর্থনীতিতে বাড়তি গতি এনে দেবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঈদ ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতি ঘটায় শহর ও গ্রামে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঈদের অর্থনীতির আকার যা-ই হোক না কেন, দেশের ভেতরে এর মূল্য সংযোজন কতটুকু সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক পণ্যই এ উপলক্ষে আমদানি হয়ে আসে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের চাহিদায়ও বৈচিত্র্য এসেছে। সব মিলে সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ চাঙা হবে বলেই ধারণা এই অর্থনীতিবিদের। কোরবানির মাংস সংরক্ষণে বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় ফ্রিজ বিক্রির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ফ্রিজ ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, দেশে বছরে ১৫ লাখ ফ্রিজের চাহিদা আছে। বছরের ৩০ ভাগ ফ্রিজই বিক্রি হয় কোরবানি ঈদে। একইভাবে কোরবানির পশু কেনার পর যে দুই থেকে তিন দিন কোরবানি দাতা নিজের কাছে রাখেন এ সময় তাকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহারের জন্য বস্তার চট কেনা হয়, খাওয়ানোর জন্য কেনা হয় খড়, ভুসি ইত্যাদি। এসব কেনার ক্ষেত্রের কয়েক কোটি টাকা হাত বদল হয় কোরবানির বাজারে যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এদিকে, এ বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে দেশে বৈধ চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে বলে অনেকে ধারণা করছেন। কারণ ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দামের ব্যবধান বেশি। বর্তমানে এক ডলার রেমিট্যান্সের বিপরীতে ব্যাংক ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা দিচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। সব মিলিয়ে প্রাহক ৯৫ থেকে ৯৬ টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু খোলাবাজারে ডলার ৯৭ থেকে ৯৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে ভিন্নপথে রেমিট্যান্স এলে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম। গত ৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে জানা গেছে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়ার কথা থাকলেও তা উল্টো কমেছে। মে মাসে তারা ১৮৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। অথচ জুন মাসে এসেছে ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার। অর্থাৎ, মে মাসের তুলনায় জুনে রেমিট্যান্স কমেছে ৫ কোটি ডলার। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডলারের দাম বাড়ানোর পরেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।