ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২১ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে। তার নাম নেয়া যাবে না, ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো যাবে না। এরপর স্বাধীনতার ঘোষক সৃষ্টি হল। ইতিহাস বিকৃতির ন্যক্কারজনক ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেই নাম মুছতে পারে নাই।
সত্যকে কেউ কখনও মুছে ফেলতে পারে না-আজ সেটা প্রমাণিত। ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
দেশের মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই কয়েকটা খুনি, বেইমান বা মুনাফেক ছাড়া সবাই জাতির পিতার জন্য কাঁদে।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার সকালে এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি সেগুনবাগিচা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে এই সভার আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন।
এ সময় তিনি বলেন, জিয়া যেমন জাতির পিতা হত্যার সঙ্গে জড়িত তেমনি জাতীয় চার নেতা হত্যার সঙ্গে জড়িত। একের পর এক ক্যু করে সেনাসদস্যদের হত্যা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করেছেন। খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় এসে ঠিক একই ঘটনা ঘটিয়েছেন।
জিয়া যেমন আবদুল আলিম থেকে শুরু করে, মাওলানা মান্নান, শাহ আজিজদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন; একইভাবে খালেদা জিয়াও নিজামী থেকে শুরু করে, যারা সরাসরি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
খুনি রশীদ এবং হুদা; তাদের ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ভোট চুরি করে পার্লামেন্টে এনে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসিয়েছিলেন।
খালেদা জিয়া কেন এটা করেছিলেন? এর জবাব কি বিএনপি দিতে পারবে? সন্ত্রাস, খুন, হত্যা, ক্যু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত, জিয়া ও খালেদা জিয়া তাদের মদদ দিয়েছেন।
বক্তব্যের শুরুতে ১৫ আগস্ট নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট শুধু একটা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়নি; এর একটা লক্ষ্য ছিল-যে আদর্শ নিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই আদর্শ এবং লক্ষ্যকে ধ্বংস করা। বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিল-এটা তারা মানতে পারেনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের পাশে ছিল, তারাও বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বিজয়কে মানতে পারেনি। কাজেই ষড়যন্ত্র চলছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, দেশের ভেতরের অনেকেই বোধহয় সেটা বুঝতে পারেনি। জাতির পিতাকে হত্যা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। পাকিস্তানিরা সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছিল।
দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতার নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে তিনি যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন. সেই সময় প্রয়োজন ছিল সব মানুষের একাত্ম হয়ে তার পাশে দাঁড়ানো এবং সহযোগিতা করা। কিন্তু আমাদের দুভার্গ্য তাকে হত্যা করা হয়।
এই প্রক্রিয়া শুরুর জন্য দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের খেলা শুরু হয়। এ ছাড়া কিছু লোক যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন দালালি করেছিল এবং পাশাপাশি কিছু লোক যারা জেনে হোক বা না-জেনে হোক নানাভাবে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, সমালোচনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাদের লেখনী ও কার্যকলাপ ছিল পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে অপবাদ ছড়ানো। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল জাতির পিতার জনপ্রিয়তা, সারা দেশের মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা-তা নষ্ট করা।
সেটা যখন তারা পারেনি তখন হত্যার পথ বেছে নেয়। যে কথাটা আমরা পাই বিবিসির কাছে দেয়া কর্নেল ফারুক ও রশিদের ইন্টারভিউয়ে।
তারা এই কথাটাই বলেছিল যে, দীর্ঘদিন চেষ্টা করছিল বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে সরাতে। কিন্তু জনগণের মন থেকে মুছতে পারেনি। তাই তারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, কর্নেল ফারুক-রশিদরাই এটা বলেছে যে, জিয়া সব সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং মোশতাক অবৈধভাবে যখন ক্ষমতা দখল করলেন, নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিলেন তখনও খুনিদের সঙ্গে এবং মোশতাকের পাশে ছিলেন। এ কারণেই জিয়াউর রহমানকে তখন সেনাপ্রধান করা হয়। এর মাধ্যমে মোশতাক এটাই প্রমাণ করে দিলেন, তারা একসঙ্গে চক্রান্তে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, মোশতাক কিন্তু বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। আমরা ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, দেখি সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করেছিল মীরজাফর। ব্রিটিশ বেনিয়ার দল তাকে ব্যবহার করেছিল। সেও কিন্তু তিন মাস ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। দু’মাসের বেশি কিছু সময় পরে তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
ঠিক মোশতাকও তাই। যাদের প্ররোচনায় সে এই বেইমানি বা মোনাফেকিটা করেছিল এবং জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডে মদদ দিয়েছিল, তারা কিন্তু তাকে ক্ষমতায় রাখেনি। ক্ষমতায় চলে আসেন আসল খলনায়ক জিয়াউর রহমান।
মোশতাকের পতনের পর জিয়াউর রহমান হয়ে গেলেন একাধারে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি। এই দুই পদ নিয়েই তিনি বিরাজমান ছিলেন। তাহলে এটা থেকে কী প্রমাণিত হয়? এইভাবে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে তারা কী করেছে? সংবিধানকে খতবিক্ষত করা হল।
সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার যারা ছিল একে একে সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর সেনাবাহিনীতে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি সেনাসদস্য ও অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের পরিবারের খোঁজও কেউ নেয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই যে রক্তঝরা, এটা শুরু হয়েছিল তখন থেকে। একটার পর একটা ক্যু হয়েছে। সেখানে সেনাসদস্যরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আমাদের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কত নেতাকর্মীর লাশ গুম করেছে, কত মানুষকে হত্যা করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জিয়াউর রহমান সেই স্বাধীনতাবিরোধী এবং যারা পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিল, তাদের ফিরিয়ে এনে মন্ত্রী বানাল।
যারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, নারী ধর্ষণ এবং নির্যাতন করেছে, পাকিস্তানিদের কাছে আমাদের মেয়েদের তুলে দিয়েছে, লুটপাট করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে-তারা হল মন্ত্রী।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেকে কেন জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর ‘কোনোদিন পাননি’ বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, তারা কি এটা পারেন?
আর এখনও দেখা যায় যে, কিছু কিছু লোক, এরা সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে। এই দেশে যত রক্তপাত, যত হত্যাকাণ্ড, যা কিছু-সবই তো সেই থেকে শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই গভীর চক্রান্ত কাজ করছিল।
যেন আমাদের বিজয়টা ধরে রাখতে না পারি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পতাকা যেন না থাকে-এটাই ছিল তাদের অপচেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি থেমে যায়।
কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে যতটুকু পারি মানুষের জন্য কাজ করে যাব। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল-বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাবেন।
কোনো মানুষ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে, কোনো মানুষ যেন গৃহহারা না থাকে, কোনো মানুষ যেন রোগে কষ্ট না পায় এবং প্রতিটি মানুষ যেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়। সবার জীবন যেন সুন্দর হয়। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি শুধু একটা কথা মাথায় রেখে, যে জাতির জন্য আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন, মানুষের পাশে থেকেছেন সব সময়।
তিনি আদর্শ নিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছিলেন। আমাদের একটাই লক্ষ্য- তার সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করব। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা বারবার আমার ওপর আস্থা রেখেছে।
আমাদের ভোট দিয়েছে। তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষকী উদ্যাপনে আমাদের অনেক কর্মসূচি ছিল, কিন্তু আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি।
আমরা কিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে করেছি। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি মানুষকে আমরা একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেব।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্যে কষ্টে না পায়, চিকিৎসাসেবা যেন পায়, তাদের জীবনটা যেন অর্থবহ হয়। সেই প্রচেষ্টাই আমরা চালাব। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জাতির পিতা পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশে বৃক্ষরোপণ করে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে আরও সবুজ, আরও শ্যামল করে গড়ে তোলা এবং দেশকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি যে কাজটা করতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে তার যে স্বপ্ন ছিল, সেটা যেন আমরা পূরণ করে এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি।
এর আগে সভার শুরুতে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা শোকাবহ যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবু নাসের চৌধুরী। এরপর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু। অনুষ্ঠানে কবি মহাদেব সাহার কবিতা আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর এমপি।
বঙ্গবন্ধুর ওপর আয়োজিত প্রদর্শনী উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর আয়োজিত চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
১৫ দিনব্যাপী এই ভার্চুয়াল চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মুক্তির মহানায়ক’। প্রদর্শনী আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় চিত্রশালা ভবনের ১, ২ ও ৩ নং গ্যালারি এবং জাতীয় চিত্রশালা প্লাজার বঙ্গবন্ধু কর্নারে চলবে। অনলাইনে http://shilpakala.gov.bd এই ওয়েবসাইডে প্রদর্শনী সম্পর্কে জানা যাবে।