ডেস্ক নিউজ
সারা বিশ্বে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা থাকলেও এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কোনও ধরনের হুমকি নেই। যেকোনও ধরনের খাদ্য সংকট এড়াতে বাংলাদেশ অনেকটাই প্রস্তুত। বোরোর বাম্পার ফলনের পর অনাবৃষ্টির নেতিবাচক প্রভাবে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শুরুতে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও এখন আর তা নেই। এরপরও ইতোমধ্যে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে অতিরিক্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন চাল দেশে এসে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, হাইতি, নাইজার, কেনিয়া, মালাউ, বুর্কিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ, মাদাগাস্কার ও মালি। এসব দেশের অনেক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগবে। এরমধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষই তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে। এর প্রভাবে দারিদ্র্য বাড়বে সারা বিশ্বে।
১৯৮৮ সালে প্রণীত সরকারের বর্তমান খাদ্যনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে— প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকদের অধিক খাদ্য ফলনে উৎসাহ প্রদান, ফসল তোলার সময় কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে বা উৎসাহব্যঞ্জক মূল্যে শস্য ক্রয়, দেশে উৎপাদিত শস্যের সুষ্ঠু সরবরাহ এবং বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্যপ্রাপ্তি সহজ করা, শস্যের উৎপাদন খরচ এবং জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খাদ্যমূল্য স্থির রাখা, উৎপাদিত কিংবা অন্য কোনও উৎস থেকে সংগৃহীত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, দুর্যোগকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ‘খাদ্য মজুত’ ব্যবস্থা অথবা দুঃসময়ে ব্যবহৃত শস্যভাণ্ডার গড়ে তোলা, খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করে ক্রমান্বয়ে খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনা ইত্যাদি। এগুলো অর্জনের জন্য ২০টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে ৩২টি নির্দেশমালা প্রস্তুত করা হয়। খাদ্য নীতিমালা কখনও কখনও লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্ভরযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করারও পরামর্শ দেয়। নীতিমালার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে— ধীরে ধীরে খাদ্যঘাটতি কমিয়ে আনা এবং জনপ্রতি খাদ্যগ্রহণের মাত্রা বাড়িয়ে প্রতিদিন তা জনপ্রতি ১৬ আউন্সে উন্নীত করা।
এদিকে বৈশ্বিক বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বব্যাংক তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে— বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির মাত্রা ভয়ানকভাবে বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা খাদ্য নিরাপত্তার বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। তবে এই ঝুঁকিতে বাংলাদেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ থেকে চাল রফতানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত ২৯ জুন থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে সরকার। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট আগামীতে আরও বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ ইউরিয়া সার ইউরোপ থেকে সরবরাহ করা হয়। গ্যাসের সংকটে একদিকে সারের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সারের দামসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বাড়ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে। তবে গত তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কৃষিপণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৩ শতাংশ কমেছে। কিন্তু আগামীতে এর দাম আবারও বাড়তে পারে বলে বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কয়েকটি দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে খাদ্য দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। ৮৮ শতাংশ স্বল্প আয়ের দেশে, ৯১ শতাংশ মধ্য আয়ের দেশে ও ৯৩ শতাংশ উচ্চ আয়ের দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫ শতাংশর ওপরে রয়েছে। এসব দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দুই অঙ্কের ঘরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ইতোমধ্যে অনেক দেশে এ হার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে যে ১০টি দেশ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে— জিম্বাবুয়েতে ৬৮ শতাংশ, লেবাননে ৩৬ শতাংশ, ইরানে ৩২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২২ শতাংশ, হাঙ্গেরি ১৮ শতাংশ, কলম্বিয়া ১৫ শতাংশ, জিবুতি ১৪ শতাংশ, রুয়ান্ডা ১৪ শতাংশ এবং বুর্কিনা ফাসোয় ১০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য দরকার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজির পর্যাপ্ততা। আর পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য উল্লিখিত পণ্যগুলো সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা বড় প্রয়োজন। বাংলাদেশে সবজি, মাছ ও ধান উৎপাদন যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা ঠিকমতো এগিয়ে গেলে সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে, নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য রফতানিকারক দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। পুষ্টি নিরাপত্তায় চালের বাইরে অন্যান্য খাবার গ্রহণ বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের খাদ্যগ্রহণের চিত্রে একমাত্র চালের পর্যাপ্ততা আছে। দিনে জনপ্রতি সাড়ে ৩০০ গ্রাম ভাত দরকার। সেই জায়গায় বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ গ্রাম ভাত খায়।
বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় দেশ। চীন ও ভারতের পর গত অর্থবছরে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিনই কৃষিজমি কমছে। সেখানে আমাদের প্রধান পণ্য চাল উৎপাদনের ধারাবাহিক যে সফলতা আসছে, তার বড় অবদান আমাদের কৃষকদের। সেই সঙ্গে কৃষি বিজ্ঞানীদের সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া নীতি সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশে খাদ্যশস্যের কোনও ঘাটতি নেই। সারা বিশ্বে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় স্বস্তির জায়গায় রয়েছে।’
একই তথ্য জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘আগামী বছর সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট থাকলেও বাংলাদেশ নিরাপদ এবং স্বস্তির জায়গায় রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশকে খাদ্য ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’