ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে রাজধানীর খাল ও ড্রেনের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হওয়া খালে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে মহাপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে দুই সিটি। বর্জ্য অপসারণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। দখল ঠেকাতে খাল পাড় বাঁধাই করে গাছের সারি, ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন তৈরি করে নান্দনিক রূপে সাজিয়ে তোলা হবে রাজধানীর খালগুলোকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নতুন বছরের শুরুতেই আমরা খালের দায়িত্ব পেয়েছি। দায়িত্ব পাওয়ার পর ইব্রাহিমপুর খালে গিয়ে ফিতা দিয়ে মেপে দেখি খালের দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ ফুট। অথচ কাগজে খাল
রয়েছে ৬০ ফুট। এর ফলে বৃষ্টি হলে পানিতে রাস্তা ভেসে যায়। আমি কালশি খাল ও গোদাখালী খাল থেকে ২০০ ট্রাক ডাবের খোসা, ৩৬টি জাজিম, নষ্ট টেলিভিশন, ফ্রিজ পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণকে বলতে চাই রাস্তা, খাল আমরা পরিষ্কার করে দেব কিন্তু তার তদারকি করতে হবে আপনাদের। নগরবাসীর সাহায্য পেলে একটি সুস্থ, সচল ঢাকা উপহার দেব। খাল দখল ঠেকাতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া থাকবে সবুজ গাছের সারি ও সাইকেল লেন। সবুজায়নে নান্দনিক রূপ পাবে রাজধানীর খাল।’ গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দায়িত্ব হস্তান্তরের পরেই খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও পরিচ্ছন্ন করার অভিযানে নেমেছে দুই সিটি। দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকা শহরে পানি জমলে কাল থেকেই প্রশ্ন উঠবে, কিন্তু ডিএসসিসি এ ব্যাপারে প্রস্তুত।’ দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গত শনিবার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমের প্রথম দিনে পান্থপথ বক্স কালভার্টের পাঁচটি ড্রেনেজ পিট (ড্রেনের মুখ) থেকে ৭৪ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পান্থকুঞ্জ পার্কের দুটি ড্রেনেজ পিট থেকে ম্যানুয়ালি ১৬ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে আর রাতে পান্থপথের বাকি তিনটি ড্রেনেজ পিট থেকে ৭৮ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। অপসারণ কার্যক্রমের তৃতীয় দিন ম্যানুয়ালি ও যন্ত্র ব্যবহার করে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। রাসেল স্কয়ার আউটলেটে রাতে যন্ত্র দিয়ে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। এ সময় পান্থকুঞ্জ আউটলেটে জমে থাকা ৫ থেকে ১০ ফুট পুরু পচনশীল বর্জ্যরে স্তর দেখা যায়। এখান থেকে প্রায় ৪৭ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। গত বুধবার সারা দিন ওই বক্স কালভার্টে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চালায় ডিএসসিসির কর্মীরা। দিন ও রাতে পরিচালিত কার্যক্রমে ৭৭ দশমিক ৬১ টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। সেগুনবাগিচা কালভার্টের গোপীবাগ আউটলেটে অপচনশীল দ্রব্য বেশি থাকায় ম্যানুয়ালি বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া নগরীর শ্যামপুর, জিরানি, মান্ডা ও কালুনগর খালে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে প্রাথমিকভাবে ম্যানুয়ালি বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। শ্যামপুর খালে বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রমও চলমান। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ডিএসসিসির মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বিলম্ব না করে শনিবার থেকে কাজ শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে আমরা পান্থপথ কালভার্ট, সেগুনবাগিচা কালভার্ট, জিরানী, মান্ডা ও শ্যামপুর খালে পরিচ্ছন্নতা কাজ শুরু করেছি। এরপর সীমানা নির্ধারণ ও উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যে এই খালগুলোতে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। যাতে এপ্রিল থেকে ডিএসসিসি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের কিছু সক্ষমতা রয়েছে তারপরও ওয়াসার কারিগরি, যন্ত্রপাতি ও জনবল সহযোগিতা নেব। ওরা দুই বছর আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, পর্যায়ক্রমে আমরা সক্ষমতা অর্জন করব। ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. বদরুল আমিন বলেন, পান্থকুঞ্জ পার্কের ভিতরে বক্স কালভার্টের গভীরতা দুই রকম আছে। কোথাও ১১ ফুট আবার কোথাও ২০-২২ ফুট আছে। আমরা কারিগরি কমিটির সহযোগিতায় সঠিক মাপটা বের করব। শুধু কালভার্টের (ড্রেনেজ পিট) পরিষ্কার করলে হবে না। ভিতরে কর্মীদের প্রবেশ করাতে হবে। মেশিন, ক্রেন কালভার্টের ভিতরে ঢুকিয়ে প্রেসার দিয়ে পানি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সাকার মেশিন দিয়ে বর্জ্য আলাদা করে বের করে আনতে হবে। কালভার্টের ভিতরের কানেকশন মুখগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, সে মুখগুলো খুলতে হবে। আমরা ২০০ মিটার করে এগিয়ে যাচ্ছি। পান্থপথ বক্স কালভার্টে মোট ২৪টি মুখ (ড্রেনেজ পিট) রয়েছে। খালগুলোর বর্জ্য অপসারণ ও সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রমে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৮০ জন শ্রমিক কাজ করছে। গত সোমবার ইব্রাহিমপুর খালে বর্জ্য পরিষ্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। অভিযানে ইব্রাহিমপুর বাজারে খালের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে নির্মিত একটি তিনতলা ভবনসহ কয়েকটি টিনশেড দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে। খাল থেকে অপসারণ করা হয়েছে বর্জ্য। অভিযানকালে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, যত প্রভাবশালী হোক না কেন খাল দখলদার কেউ ছাড় পাবে না। সিএস জরিপ অনুসারে রাজধানীর খালের সীমানা চিহ্নিত করে খালের দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পুনঃখনন করে পানি ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাড় বাঁধাই করে সবুজায়ন, ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) ও সাইকেল লেন তৈরি করা হবে। নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় তাদের জবাবদিহি করতে হয়। ওয়াসা খাল সংস্কার না করায় ডুবত ঢাকা, কথা শুনতে হতো সিটি মেয়রদের। আমরা দীর্ঘদিন ধরে খাল, ড্রেন দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে দেওয়ার জন্য বলেছি। এখন দায়িত্ব পেয়ে মেয়ররা নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করছেন। আশা করছি আগামী বর্ষায় রাজধানীর জলজট সমস্যার নিরসন হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বক্স কালভার্টগুলোর ভিতরে ময়লা জমে প্রচ- শক্ত বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য বিশেষ মেশিন প্রয়োজন হবে, যা দিয়ে ওই শক্ত ময়লা সরিয়ে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য কিছু জায়গায় বক্স কালভার্ট ভাঙার প্রয়োজন পড়তে পারে। এতে ওয়াসার বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে পারে সিটি করপোরেশন। একটা করে খাল পরিষ্কার না করে দুই মেয়রকে বসে সমন্বিতভাবে খাল পরিষ্কারে নামতে হবে।