ডেস্ক নিউজ
সরকারি কোনো উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে ৬০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের গাড়ি সরকারি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার নিয়ম। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এই নিয়ম মানছে না। এর আগে একাধিকবার প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধারের উদ্যোগও সফল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবার সমাপ্ত প্রকল্প ধরে ধরে গাড়ি উদ্ধার করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন। এ তালিকা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি)।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো কর্মকর্তা একাধিক গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি পাওয়ার পরও সরকারি গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার ও জ্বালানি তেলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। গণমাধ্যমে এসব প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন। অনেক কর্মকর্তাকে গাড়ির জ্বালানি বাবদ দেওয়া বাড়তি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে চিঠিও দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাড়ি ও জ্বালানি আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে সরাসরি দিত। এতে সরকারের গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ এবং জ্বালানি তেল বাবদ বিপুল খরচ হতো, যা সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। এরপর কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত সরকারি টাকা ও ব্যবস্থাপনায় গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অন্যতম যুক্তি ছিল- এককালীন টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে দিলে এবং সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট একটি অঙ্কের টাকা প্রতি মাসে কর্মকর্তাদের দিয়ে দিলে এসংক্রান্ত খরচ কমে আসবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। খরচ আরো বেড়ে গেছে। এর বড় কারণ প্রকল্পের বিপুলসংখ্যক গাড়ি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবৈধভাবে ব্যবহার করেন। এসব কর্মকর্তা সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি পাওয়ার পরও প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করেন। আর দুই দিক থেকেই সর্বোচ্চ খরচের জ্বালানি তেল নেন। সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও চালকের খরচ তো আছেই। এসব বিষয়ে আগে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা থাকায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখার আশায় আছেন নিয়ম মেনে চলা কর্মকর্তারা।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের গাড়ি ঠিকমতো জমা দেওয়ার কথা সব মন্ত্রণালয়কে মনে করিয়ে দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর নিজের দায়িত্বে থাকা একটি মন্ত্রণালয়। সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার সুবিধার্থে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যা চাই তাতে তিনি আপত্তি করেন না। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনের কর্মকর্তাদের গাড়ির জ্বালানি তেল নিয়ে নয়ছয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর বার্তার ভাষা বুঝতে পারবেন।’
প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে গাড়ি ও জ্বালানি তেল অপব্যবহার রোধে কঠোর নির্দেশ আসার পর নড়েচড়ে বসেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ সংশোধিত প্রাধিকারপ্রাপ্ত গাড়ি নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি গাড়ি ব্যবহার নিশ্চিতকরণ বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন।
বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন সমাপ্ত প্রকল্পের তালিকা দেওয়ার জন্য আইএমইডিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন কমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হবে। আইএমইডি থেকে তালিকা পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তার অধীন দপ্তর-অধিদপ্তরের প্রকল্পের গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দেবে পরিবহন কমিশনার।
বৈঠক সূত্র জানায়, এভাবে প্রকল্প ধরে ধরে প্রতিটি গাড়ি বাধ্যতামূলকভাবে জমা নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে কত সাল থেকে প্রকল্পের হিসাব ধরে গাড়ি জমা নেওয়া হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়নি বৈঠকে।
কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের সমাপ্তিতে প্রকল্পের গাড়ি সরকারি পরিবহন পুলে জমা প্রদানের বিধান থাকলেও তা জমা না দিয়ে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম গ্রহণ করে ১.৫০ (দেড়) কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি ক্রয় করছেন, যা তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
বৈঠকে পরিবহন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রকল্পের গাড়ি পরিবহন পুলে জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও প্রশাসনিক কাজের কথা বলে গাড়িগুলো জমা দেওয়া হচ্ছে না। সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিমের টাকায় কেনা গাড়ির জন্য আলাদা রঙের নাম্বার প্লেট দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখার প্রস্তাব দেন তিনি। এ ছাড়া একজন কর্মকর্তা পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দের পরও কেন জ্বালানি ব্যয় বাড়ছে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর পক্ষে মত দেন।
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয়ই তাদের অধীন দপ্তর-সংস্থার গাড়ি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, সরকারি গাড়ির অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনে ‘ভিজিলেন্স টিম’ গঠন করা যেতে পারে।
বৈঠকে বিভিন্ন ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম সুবিধার আওতায় গাড়ি কেনার বিষয়টিও আলোচনা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি অযৌক্তিক বলে মনে করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় বলছে, পঞ্চম গ্রেডের সবাইকে গাড়ি দিতে গেলে এমন ৫০ হাজার কর্মকর্তার পেছনে ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। সঙ্গে প্রতি মাসে এই খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ দিতে হবে। এই সামর্থ্য এখনো সরকারের হয়নি।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, যুগ্ম সচিব তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের জন্য যখন এই সুবিধা ছিল তখনো যুগ্ম সচিব মর্যাদার সব কর্মকর্তা সমান সুবিধা পেতেন না।