বিশেষ প্রতিবেদন:
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস্) এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্স (গ্যাড অ্যালায়েন্স)-এর যৌথ উদ্যোগে দেশের ১০ জেলায় সম্প্রতি চারশো জন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার সাথে মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, কভিড-১৯ মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য ঘোষিত সাধারণ ছুটি বা লকডাউন এর পর থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। নানা সংকট মোকাবেলা করে বাকি ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তাদের উদ্যোগ বা ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তারা জানিয়েছেন লকডাউনকালীন সময়ে পরিবারের খাবার ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ করার জন্য তারা তাদের ব্যবসার মূলধন খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলেও মূলধনের অভাবে তাদের ব্যবসা বা উদ্যোগগুলি পরিচালনা করা কঠিন হবে বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। সাক্ষাৎকারে তারা দাবি জানিয়েছেন যে, ব্যবসার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সরকারের প্রণোদনার অংশ হিসেবে তাদের জন্য সহজ শর্তে, বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে। সরকারের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক সহ অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে এ উদ্যোগ যাতে কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
গত মার্চ ২০২০ থেকে দেশে কভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে শুরু হওয়া লকডাউনের কারণে অন্যসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো দেশের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের কার্যক্রমও কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। জুন থেকে সীমিত পরিসরে জরুরি পরিষেবা কার্যক্রম, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নানান প্রতিবন্ধকতা ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার ফলে তাদের এতোদিনের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলি বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ নারী উদ্যোগের এই ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হলে নারীর সামগ্রিক অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে স্টেপস ও গ্যাড অ্যালায়েন্স।
দেশে কভিড-১৯ সময়ে পরিবারের সদস্যদের খাবার যোগান দেয়া, নিয়মিত নানাবিধ চাহিদা মেটানোসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা তাদের দীর্ঘদিনের অর্জিত সম্পদ এবং পুঁজি হারিয়েছেন। একইসাথে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হারানো সহ তারা তাদের নিয়মিত ক্রেতা ও ব্যবসায়িক নেটওর্য়াকের বাইরে চলে এসেছেন। ফলে থমকে গেছে তাদের উদ্যোগ ও ব্যবসা। অন্যদিকে তাদের উপর বাড়ছে ঋণের বোঝা। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং পরিবারে তাদের যে অবদান তা ক্রমান্নয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
স্টেপস এবং গ্যাড অ্যালায়েন্স সুফিয়া কামাল ফেলোদের সহায়তায় গত মে মাসের শেষ দশদিনে দেশের দশটি জেলায় প্রায় চারশত ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার উপর মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে এসময়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের আয় না থাকার কারণে নারী উদ্যোক্তাদের উপর পুরো সংসারের দায় এসে পড়েছে। অন্যদিকে কভিড-১৯ সময়ে স্থানীয় পর্যায়ের মার্কেট বন্ধ থাকা সহ মানুষের সীমিত চলাচলের কারণে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় তাদের সংকটে পড়তে হয়েছে। গত বাংলা নববর্ষ এবং ঈদের সময় ক্রেতা না থাকায় তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারেনি, অথচ বছরের এই দুটি উৎসবের সময়ই সাধারণত তাদের ব্যবসার মূল সময়। এর ফলে একদিকে কমেছে তাদের নিজেদের আয়, অন্যদিকে তাদের উৎপাদন সহযোগী গ্রামীণ অসহায় নারীদের মজুরি প্রদানেও ব্যর্থ হয়েছেন বলে তারা জানিয়েছেন। মূলত উৎসব কেন্দ্রিক এসব ব্যবসায় এবার ভাটা পড়েছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের এতোদিনের শ্রমে অর্জিত ছোট ছোট উদ্যোগ এবং ব্যবসা। ঘাড়ে চেপে বসেছে ঋণের বোঝা। সামাজিক কর্মকান্ডে তাদের অংশগ্রহণ কমেছে। অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের পরিবারের শিশুদের শিক্ষাজীবন।
সাক্ষাৎকারভিত্তিক পর্যবেক্ষণ–এর উদ্দেশ্য:
- কভিড-১৯ মহাদুর্যোগের সময়ে গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ ও ব্যবসাসমূহ কী অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
- ক্ষুদ্র গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসার ভবিষৎ ঝুঁকিসমূহ চিহ্নিত করা।
- গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসার সংকট মোকাবেলার জন্য করণীয় সম্পর্কে জানা।
- বিষয়গুলি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা উত্থাপন করা, যাতে করে ক্ষুদ্র গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়।
পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি ও সময়কাল:
সাম্প্রতিক সময়ে স্টেপস্-এর কর্মএলাকার ১০টি জেলায় চারশত গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং তার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। মূলত ৫টি প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে মোবাইলে ৪০০ জন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন স্টেপস এবং গ্যাড অ্যালায়েন্স-এর সাথে দীর্ঘসময় কর্মরত এবং সেইসঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের সাথে অব্যাহত সহযোগী এলাকার সুফিয়া কামাল ফেলোগণ। প্রতি জেলায় ৪০ জন করে নারী উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। লকডাউনের সময়কালে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা ছিল বেশ কঠিন। এ কারণে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়েছে । গত ২০ মে থেকে ৩০ মে, ২০২০ মোট ১০দিন ধরে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের বর্তমান পরিস্থিতি:
- সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবসা বন্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে কভিড-১৯ এসময়ে।
- বাকি ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা কোনোমতে তাদের ব্যবসার চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছেন।
- অংশগ্রহণকারী ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ জানিয়েছেন তারা এ কভিড-১৯ সময়ে তাদের ব্যবসার ধারাবাহিকতার জন্য বাজার থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে পারেননি। ফলে তাদের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
- অন্যদিকে ৪৬ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা জানিয়েছেন এসময়ে যানবাহন বন্ধ থাকার কারণে অনেক কষ্টে চড়ামূল্যে বাজার থেকে কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে পেরেছেন। একারণে বর্ধিত উৎপাদন খরচে এসময়ে সীমিত আকারে উৎপাদন করলেও পণ্যের বেশি দামের কারণে ক্রেতাদের নিকট তারা পণ্য বিক্রয় করতে পারেননি। ফলে তাদের অবিক্রিত পণ্য পড়ে আছে, যা আগামীতে বিক্রি হওয়া নিয়েও তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। এসব কারণে চারিদিক থেকে নারী উদ্যোক্তারা পড়েছেন চাপের মুখে।
- এই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন যে, ইতোমধ্যে তাদের নানা দায় মেটাতে স্থানীয় মহাজনদের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। ফলে ঋণের জালে তারা জড়িয়ে পড়ছেন। অন্য নারী উদ্যোক্তাদেরও একই পথে হাঁটতে হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
- এছাড়াও দীর্ঘ সময়ে বাজারে না থাকার কারণে তাদের জায়গা বেদখল হয়ে যাবে বলে তারা আশংকা প্রকাশ করেছেন। নারীদের তিল তিল শ্রমে এবং মেধায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট উদ্যোগ ও ব্যবসার পুঁজি হারানোর ফলে তাদের আগামীদিনের চলার পথ আরও সংকটময় হবে বলে তারা জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে নারীদের যে অর্থনৈতিক অবদান ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
- নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগি গ্রামীণ নারীরাও ইতোমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের পরিবারও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছে।
চ্যালেঞ্জসমূহ:
- গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের পুঁজি হারানোয় তাদের ব্যবসা বা উদ্যোগসমূহ বন্ধ হবার পথে।
- বিভিন্ন সংগঠন থেকে সংগৃহিত ঋণের টাকা তারা কীভাবে পরিশোধ করবেন, সেবিষয়ে তারা পরিষ্কার নন।
- পরিবারের চাহিদা মেটাতে না পারার কারণে বেড়েছে মানসিক চাপ, সেইসাথে ভীতি ও শংকা। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যয় মেটাতে না পারার কারণে, পরিবারের শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
- অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
- নিজেদের ব্যবসা বন্ধজনিত জটিলতায় তারা সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাÐে যুক্ত হতে পারছেন না। তাদের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতা কাঠোমোয় তাদের যুক্ততার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।
- তাদের উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা ও বাজার সীমিত হয়ে গেছে। বাড়ছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি।
- ঋণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকার কারণে কেউ কেউ স্থানীয় মহাজনদের নিকট থেকে চড়াসুদে ঋণ গ্রহণ করছেন।
- ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহ তাদের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করলেও পুরানো ঋণ থাকায় নতুন করে ঋণ গ্রহণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। একইসাথে নানা জটিলতার কারণে ব্যাংক থেকেও তারা ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন না।
- পরিবারের নানামুখি চাপ সামলাতে ব্যর্থ হবার কারণে কোথাও কোথাও তাদের উপর পারিবারিক নির্যাতন হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন।
ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আশু করণীয়:
- প্রণোদনার অংশ হিসেবে দেশে গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ প্রদান।
- ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন তার সুদ মওকুফ করা। অর্থাৎ গত মার্চ থেকে আগামী ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মোট ১০ মাসের ঋণের সুদ মওকুফ।
- ভবিষৎ ব্যবসা ও উদ্যোগসমূহ পরিচালনার জন্য নারী উদ্যোক্তারা যারা তাদের সঞ্চয় ফেরত পেতে আগ্রহী তাদের সঞ্চয় ফেরত দিয়ে, মূলধন হিসেবে পরবর্তীতে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সহযোগিতা করা। যাতে করে তারা তাদের টাকা দিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
- তাদের উৎপাদিত পণ্য যাতে পুনরায় বাজারে সহজে প্রবেশ করতে পারে সেজন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ।
- গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনী কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা।
- প্রণোদনার অংশ হিসেবে গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের এককালিন সহায়তা প্রদান।
যে সব জেলায় এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।
দেশের ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল ও চট্টগ্রাম জেলায় এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।