পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে শীতকালে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ফেরি কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে, প্রতি ২৪ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকলে এই রুটের উভয় পাড়ে কম করে হলেও ৬০ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এই লোকসান পুষিয়ে নিতে ফেরি কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি সেক্টরে পরীক্ষামূলকভাবে ১০টি ফেরিতে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফগ অ্যান্ড সার্চ লাইট (ফগলাইট) স্থাপন করে। কিন্তু ব্যয়বহুল এই লাইট স্থাপন করার পরও ঘন কুয়াশাকে টেক্কা দিয়ে এক মিটার পথ অতিক্রম করতে পারেনি ফেরি। ভুক্তভোগী এক ফেরির মাস্টার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কুয়াশার ঘনত্বের কাছে ফগলাইটের আলো যেন কুপির বাতি।
ঘন কুয়াশা মানেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ফেরি সেক্টরসমূহে লোকসানের ঘানি টানা। ঘন কুয়াশায় ঢাকা মহানগরীসহ পাটুরিয়া ঘাট হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনেক সময় পণ্যবাহী যানবাহন পার হতে এই ঘাটে সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়। এ মাসে পৃথক আট দিনে কম করে হলেও ঘন কুয়াশার কারণে ৭২ ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় সংস্থা প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সোমবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচলরত রো-রো বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ফেরির ইনচার্জ মাস্টার ক্যাপ্টেন শফিকুর রহমান শফিকসহ কয়েকজন মাস্টারের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ফেরিতে ফগলাইট লাগিয়েও ঘন কুয়াশায় ফেরি চালানো সম্ভব হয় না। ফগলাইট জ্বালানোর ফলে নৌপথ আরও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অত্যন্ত সাদা এ লাইটের রশ্মির দিকে তাকানোর ফলে এখন চোখে ঠিকমতো দেখতে পাওয়া যায় না। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা এরিয়া অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মহিউদ্দিন রাসেল জানান, শীত মৌসুমে ঘনকুয়াশার কারণে মাঝে মাঝে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এতে বিআইডব্লিউটিসি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় বঞ্চিত হয়। তার হিসাব মতে, পাটুরিয়া প্রান্তে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গাড়ি পার থেকে আয় হয় ৩০ লাখ টাকার মতো। দুই প্রান্ত মিলিয়ে ৬০ লাখ টাকা হবে। আয় বঞ্চিতের পাশাপাশি ফেরি পার হতে আসা যানবাহনগুলো ঘাটে আটকে থাকায় যাত্রীসাধারণকে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি ও দুর্ভোগ।
সূত্র মতে, রো-রো ফেরি ভাষা শহীদ বরকত, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর, খানজাহান আলী, শাহপরান, শাহ্আলী, কেরামতআলী, আমানত শাহ ও কপতী ফেরিতে ফগলাইট স্থাপন করা হয়। সোমবার একজন ফেরি মাস্টার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এমনিতে শুরু থেকে তিনি কখনও কুয়াশা ভেদ করে চালাতে পারেননি। বর্তমানে তার ফেরিতে লাগানো ফগলাইটটি এখন আর জ্বলে না।
ফগলাইট কিনতে নানা অনিয়ম
অভিযোগ রয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে ব্যয় বহুল এই ফগলাইটগুলো আনা হয়। আমেরিকার তৈরি এবং ওই দেশ থেকে আমদানি দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে ফগলাইটগুলোর কিছু যন্ত্রপাতিতে মেড ইন কোরিয়া লেখা পাওয়া গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে এই ফগলাইটগুলো কতটুকু বাস্তবসম্মত তা দেখতে পরীক্ষামূলকভাবে পাটুরিয়া ও মাওয়া ফেরি সেক্টরে মাত্র দুটি ফেরিতে দুটি ফগলাইট লাগনোর সিদ্ধান্ত থাকলেও বিশেষ মহলের চাপে নিয়ম ভেঙে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ফগলাইট কেনা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৫ জুন ওই ফগলাইটগুলো ফেরিতে সংযুক্ত করা হয়। মেসার্স জনি করপোরেশন এই ফগলাইট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বিআইডব্লিউটিসির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের (ঘন কুয়াশা) মধ্যে যাতে ফেরি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা যায় এ জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। এ জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সদস্য ও বিআইডব্লিউটিসি’র চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে একটি প্রকল্প কমিটি করা হয়। সভায় প্রকল্পের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ধাপে পাটুরিয়া ও মাওয়া ফেরি সেক্টরে একটি করে দুটি ফেরিতে ব্যয় বহুল এই ফগলাইট স্থাপন করা হবে। পরে ঘন কুয়াশার বিরুদ্ধে ফগলাইটে সাফল্য পেলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান, মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, প্রকল্পের পরিচালক সাবেক জিএম (মেরিন) শওকত সরদারসহ প্রকল্পের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি টিম প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। প্রকল্পের সদস্যরা আমেরিকায় বসেই প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন কাজটি সম্পন্ন করেন।
সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রীর ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্পের পিডি ক্যাপ্টেন শওকত সরদার বিশেষ ভূমিকা রাখেন বলে জানা গেছে। এ জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াটিও দ্রুত করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে অভিজ্ঞ কোনও কোনও ঠিকাদারের ওই দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রকল্পের সুফল না পেয়ে সংস্থার সাড়ে ছয় কোটি গচ্চা দেওয়ার বিষয়টি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
সংস্থার নির্ভযোগ্য ওই সূত্র আরও জানায়, সরবরাহকৃত সাত হাজার ওয়াটের উচ্চ ক্ষমাসম্পন্ন ফগলাইটগুলো যখন ফেরিতে লাগাতে আসেন, তখন বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যা দেখা দিলে প্রকল্পের রিসিভিং কমিটির সব সদস্য লাইটগুলো গ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিডিউলের সঙ্গে ফগলাইটের মালামালের মিল না থাকায় কমিটি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে তাদের নানা প্রলোভন দেখানো হয়। পরে একপর্যায়ে ওই কমিটির কয়েকজনকে বদলিসহ ভয়ভীতি দেখিয়ে লাইটগুলো গ্রহণে বাধ্য করা হয়।
এসব ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসি আরিচা ফেরি সেক্টরের এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানান, ফগলাইট যখন জ্বালানো হয়, তখন ঘনকুয়াশার জলকনাগুলো আরও বিস্তার ঘটিয়ে ফগলাইটিকে কুয়াশায় আটকে ধরে। তখন সব কিছু ধুয়াশা দেখা যায়। এ বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তারাও সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।
আরিচা ফেরি সেক্টরের এরিয়া অফিসের জেনারেল ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) মো জিল্লুর রহমানকে ফগলাইটের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে তিনি কুয়াশার মধ্যে না জ্বলার কথা জানান। শুরু থেকে একদিনের জন্যও ফগলাইটের সুফল পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।