মুজিববর্ষে গৃহহীন-ভূমিহীনদের ঘর উপহার দেওয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজ আমার আনন্দের দিন। যাদের কিছুই ছিল না, তাদের ঘর দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পেরেছি।
যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে, তখন আমার মা-বাবার আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ, এসব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তো ছিল আমার বাবার লক্ষ্য।
বাংলাদেশের মানুষের এর চেয়ে বড় উৎসব হতে পারে না। যারা ঘর পেয়েছেন, প্রত্যেককে নিজের ঘরের সামনে অন্তত একটি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শনিবার সকালে সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৬৬ হাজারের বেশি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকে পাকা ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত দুই শতাংশ জমির মালিকানার কাগজপত্রও তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গৃহহীনদের জন্য নির্মিত চারটি উপজেলার আশ্রয়ণ নিবাসের উপকারভোগী মানুষ সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এছাড়া দেশের ৬৪টি জেলার সব উপজেলার মানুষও টেরিস্ট্রিয়ালে এই অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, জাতির পিতা এদেশের মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু নিজের কথা কখনো চিন্তাও করেননি। স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। সেটা বাস্তবায়ন করে যেতে পারলে বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগেই উন্নত হতে পারত।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতের দৃঢ়প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মুজিববর্ষে একটি মানুষও গৃহহীন-ঠিকানাহীন থাকবে না।
আমরা সবার জন্য ঠিকানা করে দেব, সবাইকে ঘর করে দেব। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে, সেটাই আমার লক্ষ্য।
এদিন ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার দুই শতাংশ খাসজমির মালিকানাসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট গৃহ মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে পেয়েছেন। একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে বিনামূল্যে ঘর করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বে অনন্য নজির সৃষ্টি করল বাংলাদেশ।
‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহহীন থাকবে না এমন ঘোষণার বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীন চলমান গৃহ ও জমি প্রদান কর্মসূচির প্রথম পর্যায়ে সারা দেশে এসব ঘর পায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার।
ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর করে দিতে এখন পর্যন্ত প্রায় নয় লাখ পরিবারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে ভূমি ও ঘর দেওয়া হবে।
একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঘর দেওয়াকে বিরল নজির হিসাবে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি জানি না পৃথিবীর কোনো দেশে কখনো অথবা আমাদের দেশে কোনো সরকার এত দ্রুত এতগুলো ঘর করেছে কি না।
এই ঘরগুলো তৈরি করা সহজ কথা নয়। এজন্য সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি বলেন, এতটা সমন্বিত কার্যক্রম এর আগে দেশে এভাবে হয়নি।
করোনাভাইরাসের মধ্যেও দেশ এগিয়ে নিতে তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান বলেন, করোনা যেমন একদিকে অভিশাপ, তেমনই আমাদের জন্য আশীর্বাদও বয়ে এনেছে। কারণ এই সময়ে আমরা কাজগুলো ভালোভাবেই করতে পেরেছি।
দেশের মানুষের দোয়া চাই, যেন এই দেশটাকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা হিসাবে গড়ে তুলতে পারি। প্রতিটি মানুষ যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। তারা যেন সুন্দর ও উন্নত জীবন পায়, সবার ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।
পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ছয় বছর নিজের নির্বাসিত জীবনের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জিয়াউর রহমান আমাকে ও আমার বোনকে ছয় বছর দেশে ঢুকতে দেয়নি। পাসপোর্ট পর্যন্ত রিনিউ করতে দেননি।
আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি করার পর মানুষের কথা চিন্তা করেই জোর করে দেশে ফিরে এসেছি। আমার লক্ষ্য একটাই-আমি নিজে কী পেলাম বা পেলাম না, সেটি বড় কথা নয়। মানুষকে কী দিতে পারলাম, সেটিই বড় কথা।
বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসকদের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ তখন কী পেয়েছে?
অনেকে গালভরা কথা বলেন, মানুষ নাকি তখন গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছে! গণতান্ত্রিক অধিকার কী? একটি মিলিটারি ডিকটেটর মানুষকে শোষণ-নির্যাতন করবে, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি নামের দল গঠন করে ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনে ১১০ ভাগ ভোটও পড়েছিল! আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগকে ৪০টির বেশি আসন দেওয়া হবে না।
সেবার আওয়ামী লীগকে ৩৯টি আসনই দেওয়া হয়েছিল। যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, এটা কী ধরনের গণতন্ত্র? একটি দল সৃষ্টি হলো, যে দলটি শিশু, হাঁটতে শেখার আগে সেই দলটিই ক্ষমতায় চলে গেল?
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুঃশাসনের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল দেশের জন্য সত্যিকারের একটা অন্ধকার যুগ ছিল। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি-লুটপাট ২০০১ সালে বিএনপির সময়ই শুরু হয়েছিল। তাদের কারণেই পরে ওয়ান-ইলেভেন আসে।
ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। মোনাজাত পরিচালনা করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান।
পরে দেশের চারটি জায়গা থেকে উপকারভোগীরা যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। প্রথমেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয় খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঁঠালতলা গ্রাম।
সেখানে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মধ্যমে উন্মুক্ত স্থানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ। সেখানে ঘর পেয়েছেন এমন উপকারভোগী পারভীন।
পাকা ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাদের ঘর দিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখুন। আপনার জন্য অনেক দোয়া করি।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনি কাঁদবেন না। আজ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসাবে তার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। এজন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছি।
দেশের একটি মানুষও যেন গৃহহীন না থাকে, সেই ব্যবস্থা আমরা করব।
এরপর প্রধানমন্ত্রী নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুর গ্রামের ঘর পাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির আহমেদের সঞ্চালনায় সেখানে উপকারভোগীরা প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানান।
সেখানে এক উপকারভোগী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে সালাম দিয়ে জানতে চান-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কি ভালো আছেন? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ভালো আছি। আপনারা কি খুশি?
জবাবে তিনি বলেন, ‘খুশি, খুব খুশি। স্বামী-সন্তান নিয়ে মানুষের বাড়িত আছিনু। খুব কষ্টে আছিনু। এখন শেখের বেটি শেখ হাসিনা মোক জায়গা জমি, ঘর, কল, সবকিছুই উপহার দিছে। এখন হামরা খুব খুশি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তোমরা দীর্ঘজীবী হও। সুস্থ থাকো, ভালো থাকো, আর এই দেশের উপকার করো।’
পরে উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য ভাওয়াইয়া গানের সুরে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান উত্তরের এই জেলার সুবিধাভোগীরা। সুরে সুরে গান ‘বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা আমার শেখ হাসিনা, দেশ বিদেশে নাই যে তুলনা।’ গান শুনে হাততালি দিয়ে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুব ভালো লাগছে। সেখানে তো আপনারা মেলা বসিয়েছেন। নিশ্চয় শীতের পিঠাটিটা খাওয়া হচ্ছে। সবাই ভালো থাকেন সেই দোয়া করি।
সৈয়দপুরের হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের ইকরতলী গ্রামে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলের সবাই তো আমার পরিবারের মতো।
এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে সংসদে কথা হয়। আমি একটু উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এ সময় সেখানে ঘর পাওয়া দরিদ্র নুরু মিয়া প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলেন, ‘দুই শতক জায়গাসহ আপনি আমাদের সুন্দর পাকা ঘর দিয়েছেন।
আমরা আজ অনেক খুশি। আমি এখন আমার বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারমু। আমি আপনার জন্য দোয়া করমু আল্লাহ যেন আপনার হায়াত বাড়াইয়া দেয়। আপনি যেন আরও গরিব-দুখীদের সাহায্য করতে পারেন।’
তার বক্তব্য শোনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি খুব খুশি হলাম। আপনারা ভালোভাবে থাকেন, এটাই আমি চাই।
এরপর প্রধানমন্ত্রী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের সল্লাগ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নামজুল ইসলাম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
তিনি আমের রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে তার উপজেলায় নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরেন। শুরুতেই উপকারভোগীরা ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলান। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে তাদের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গান শোনানোর অনুমতি চান।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী আল্পুতকণ্ঠে বলেন, অবশ্যই গম্ভীরা গান শুনব। প্রথম গম্ভীরা গান শুনেছিলাম ১৯৭৪ সালে বাবার সঙ্গে নাটোরে গিয়ে। সেখানে নানা-নাতি এসে গম্ভীরা শোনায়।
এখন অবশ্যই গম্ভীরা শুনব। এ সময় হারমুনিয়াম, ডুগি-তবলা নিয়ে এবং নানা-নাতি তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে তালে ও লয়ে গম্ভীরা পরিবেশন করেন-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জানাই সাদর সম্ভাষণ, আপনি করছেন দেশের উন্নয়ন, হে নানা ভূমিহীন মানুষেরা তাইতো পাইলো সুখের দর্শন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার, শেখ হাসিনা সেই কাজ করছেন বরাবর।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে উচ্ছ্বসিতভাবে তা উপভোগ করতে দেখা যায়।
পরে সেখানে ঘর পাওয়া এক শারীরিক প্রতিবন্ধী উপকারভোগী ফাতেমা বেগম প্রধানমন্ত্রীকে সালাম দিয়ে বলেন, ‘আমার কোনো ঠিকানা ছিল না। আজ আপনার দেয়া জমি আর বাড়িতে আমার ঠিকানা হয়েছে। এখানে আমার পরিবার নিয়ে বসবাস করতে পারবো। আমি খুব খুশি হয়েছি। আল্লাহর কাছে আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া করি। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। আমার মতো আরও অসহায় মানুষের উপকার করতে পারেন।’