- এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১ প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে
- রফতানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা
- কর্মসংস্থান টিকিয়ে রেখে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হবে
- আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে সিরিজ বৈঠক
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে ঘোষিত ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজের দ্রুত বাস্তবায়ন, অর্থনীতির প্রধান খাত রফতানি ও রেমিটেন্সের স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত রাখা। এজন্য ২৬ নবেম্বর থেকে শুরু হবে সিরিজ বৈঠক। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ২১টি খাতে এক লাখ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মকৌশল প্রণয়ন শুরু হয়েছে। নতুন এই কৌশলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি রক্ষা করার রূপরেখা থাকবে। বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় আবার বেড়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতির প্রধান খাত রফতানি ও রেমিটেন্স নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান কমে গিয়ে আবারও বেকার সমস্যা দেখা দেয়ার একটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এজন্য রফতানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা এবং কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ থাকবে। কর্মসৃজন ও গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এবং সামাজিক সুরক্ষা কর আওতা সম্প্রসারণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেও এবার জোর দেয়া হবে। পাশাপাশি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রফতানিমুখী গার্মেন্টস, করোনা রোগীকে সেবা প্রদান, বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্থগিত ঋণের আংশিক সুদ মওকুফ, এসএমই খাতের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, রফতানিকারকদের জন্য প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফাইন্যান্স, কৃষি ভর্তুকি ও উৎপাদন বাড়ানোর মতো কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী সকল পক্ষের সঙ্গে আবার বসতে যাচ্ছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল।
২৬ নবেম্বর বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য ওই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিনিধি দল মতামত তুলে ধরবে। এছাড়া প্রণোদনা বিষয়ে বিশ^ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি মিয়াং টেম্বন, বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাউকি প্রমুখ উপস্থিত থাকবেন। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। ধারাবাহিকভাবে তিন পর্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে। প্যানেল আলোচনায় থাকবেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট ড. রুবানা হক প্রমুখ। প্রথম সভার পর প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আরও দুটি বৈঠক ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তায় করা হবে। সেখানেও সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে একটি রূপরেখা তৈরি করা হবে।
করোনা মহামারী মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ইতোমধ্যে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত প্যাকেজ বাস্তবায়ন না হলে দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বিশ^ব্যাপী দ্বিতীয় দফা করোনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশে^র অনেক দেশ আবার লকডাউন ঘোষণা করছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে দক্ষতার সঙ্গে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ হতে উদ্ভূত সঙ্কট মোকাবেলায় ও ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। এর আওতায় সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লাখ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। যার বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। সরকারের নেয়া প্যাকেজসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতির একটি হালচিত্র অর্থ বিভাগের উদ্যোগে চলতি মাসের গত ২ নবেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় নিয়মিত বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।
ওই সভায় জানানো হয়, প্রণোদনা কর্মসূচীর বিভিন্ন দিক ও দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অবদান বিষয়ে সর্বমহলে অধিকতর সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে কোভিড-১৯ মোকাবেলা এবং টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ বিষয়ে একটি সিরিজ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য সভার প্রথম প্রতিপাদ্য বিষয় কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয় সভার প্রতিপাদ্য বিষয় কর্মসৃজন ও গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর আওতা সম্প্রসারণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হবে।
প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয় এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কারণে এবারের সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নিজস্ব মতামত তুলে ধরবেন। এই সভার গুরুত্বটি তুলে ধরতে অর্থসচিব বাণিজ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিতে বলেন, কোভিড-১৯ জনিত কারণে লকডাউন আরোপ এবং কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, স্থবিরতা ও কর্মহীনতা দেখা দেয়। বাংলাদেশও এর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না। উদ্ভূত সঙ্কট মোকাবেলায় ও ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করতে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু সরাসরি তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সময়োপযোগী ও কার্যকর ও প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী, কৃষক ও রফতানিমুখী শিল্পে কর্মরত কর্মী এ প্রণোদনা কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় বড় ফান্ড দরকার। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি করোনা থেকে রক্ষায় বাজেটে থোক বরাদ্দ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে, এটা ভাল দিক। কারণ এ রকম একটা ফান্ড থাকলে জরুরী প্রয়োজনে টাকার জন্য ঘোরাঘুরি করার প্রয়োজন হবে না।
করোনা পরবর্তী বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়াতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারী- বেসরকারী খাতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। চলমান করোনা পরিস্থতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কাজ করছে এই টাস্কফোর্স। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক এবং প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে গঠন করা এ তহবিল থেকে গ্রাহকরা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এই ঋণ দেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়ভাবে কৃষি এবং বিভিন্ন আয়ের উৎস কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার স্থানীয় উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান এ তহবিলের ঋণ সুবিধা পাবে।
এছাড়া হতদরিদ্র অথবা অনগ্রসর গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তি এবং অসহায়, নিগৃহীত নারী সদস্য এ ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন। এ তহবিলের মেয়াদ হবে তিন বছর। দেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণ করা হবে। তবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করবে এই স্কিম থেকে পুনঃঅর্থায়নে আগ্রহী তফসিলী ব্যাংক, যারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বার্ষিক মাত্র ১ শতাংশ সুদে তহবিল পাবে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ব্যাংকগুলো এই তহবিল দেবে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদে। আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ৯ শতাংশ সুদ গুনবেন। এই সুদ অনেক বেশি মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা সুদ কমানোর দাবি করেছেন। এছাড়া করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সমুদয় ঋণ অক্টোবরের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এর মধ্যে যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ার দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, করোনার প্রভাব মোকাবেলায় সারা দেশে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বহুমুখী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।