ডেস্ক নিউজ
বাস্তবতা বিবেচনায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আরও বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যে চীনের নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসিইপি) যোগ দিতে যাচ্ছে ঢাকা। এই বছরের শেষ নাগাদ এই সংক্রান্ত চুক্তি সই হতে পারে। ১৫টি দেশের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ।
আরসিইপি চুক্তির মূল লক্ষ্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। একই সঙ্গে চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোও বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ইস্যুকে শতভাগ প্রাধান্য দিয়ে উভয় পক্ষ লাভবান হয় এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ জোরেশোরে চলছে।
জানা গেছে, চীনের সঙ্গে আরসিইপি চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ইতোমধ্যে চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে উভয় পক্ষের কর্মকর্তাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে।
প্রাথমিক সমীক্ষায় চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা হয়। সম্প্রতি আরসিইপি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকটি ওয়ার্কশপ হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন ও ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কোনো কিছুই চিন্তা করা যায় না। আর এ কারণেই আরসিইপির ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের সুবিধা এবং ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রস্তুত করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। এগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের পর চুক্তি করা হবে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর বাণিজ্য অংশীদার চীন। বেইজিং থেকে আমদানি বাড়লেও সেই তুলনায় রপ্তানি নেই। ফলে প্রতিবছর দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, আরসিইপি চুক্তি করা হলে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি হলে রপ্তানি বাড়বে। আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ওই সময়ের পর বিশ্বের অনেক দেশেই শুল্ক ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। এ অবস্থায় আরসিইপি চুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ ছাড়াও এই চুক্তিতে সই করছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। ভারতের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও সস্তা চীনা পণ্যে বাজার ছেয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায় দেশটি। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) জোটের ১০ সদস্য- ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সসহ মোট ১৫টি দেশ ২০২০ সালে এই চুক্তিতে সই করেছে।
বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক জোট হতে যাচ্ছে আরসিইপি। এই জোটের সম্মিলিত অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করেছে। অনেকেই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যকার মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চেয়েও বড় এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য সদস্য দেশের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে শুল্কের পরিমাণ হ্রাস, বাণিজ্য সেবার উন্মুক্তকরণ এবং উদীয়মান অর্থনীতির সদস্য দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন।
বিশেষ করে, আরসিইপির মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খরচ ও সময় কমিয়ে এ জোটের যে কোনো সদস্য দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা বিধিমালার ঝামেলা এড়ানোর সুযোগ পাবে কোম্পানিগুলো।
জানা গেছে, চীনের আরসিইপি চুক্তির ফলে বাংলাদেশে কয়েক ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এতে চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠবে, ফলে তারা সস্তায় কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে তারা আরও কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করবে। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো আরও বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো একে অপরকে বিনিয়োগ সুবিধা দেবে, ফলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগের বেশির ভাগই যাবে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশে, যা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সঙ্কুচিত করবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশ শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে- এমন বড় দেশও চীনের নেতৃত্বাধীন আরসিইপি জোটে আছে। চুক্তিতে সই করার আগে আরও বেশি বিশেষজ্ঞ গবেষণার পরামর্শ দেন তিনি। এই গবেষক বলেন, কোনোভাবেই দেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ঝুঁকিতে না পড়ে সেদিকে সজাগ ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, চীনের সাথে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে ৬৮০ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে চীন থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য।