ডেস্ক নিউজ
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৫ মাসের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কর্মপরিকল্পনায় গ্রামে ব্যালট পেপার এবং মহানগর আর জেলা সদরের সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্র্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ইসি বলছে- ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে-পরে ইচ্ছামতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব। কিন্তু ইভিএমে এ ধরনের অন্যায় করার সুযোগ নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি; জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ঠেকানোসহ ১৪টি প্রধান চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল নির্বাচন ভবনে এক অনুষ্ঠানে এই কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, আগামী বছরের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে ইসিকে। ইসি বলছে, আগামী নভেম্বরে তফসিল দিয়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা ২০২৪ সালের জানুয়ারির শুরুতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এদিকে ভোটের মাঠে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন, ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি, অর্থ ও পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, সব দল কর্তৃক নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ, প্রার্থী এজেন্ট ও ভোটারদের কেন্দ্রে আসা নিশ্চিত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ইসি। এর পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মহানগর আর জেলা সদরের সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ; প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরায় নজরদারি; সবাইকে নির্বাচনী প্রচারে সমান সুযোগ দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়াসহ ১৯টি উপায় নির্ধারণ করেছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ৭টি করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে রোডম্যাপে। এ ছাড়া নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে ২৯ রাজনৈতিক দলের মতামতকে তিন ভাগে ভাগ করেছে কমিশন। এর মধ্যে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে ১২ দল; সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে ৬ দল ও শর্তসাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে ১১টি দল মত দিয়েছে বলে কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বর্তমান ইভিএমে ভিভিপ্যাট সংযোজনের সুযোগ নেই বলেও স্পষ্ট জানিয়েছে কমিশন।
এদিকে অসুস্থতার কারণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই সিনিয়র নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য একটাই- ‘অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন করা। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন এবং আমরা অনেক আস্থার ঘাটতির মধ্যে আছি। আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ দিয়েছি, আমরা কিছুটা হলেও আগের থেকে আস্থা অর্জনে এগিয়ে গেছি।’ এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের ‘জবাবদিহিতা ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাও’ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এ নির্বাচন কমিশনার।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে নির্বাচন কশিমনার মো. আলমগীর বলেন, এ কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করেছি আমরা। যেসব বিষয় আমাদের আওতায় রয়েছে, তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সুপারিশগুলো রাখা হয়নি। তিনি বলেন, রোডম্যাপের চ্যালেঞ্জগুলো ধরে মোকাবিলা করে সব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। ভোটের এখনো এক বছর চার মাস বাকি। অনেকে ইসি নিয়ে আস্থাহীনতায় থাকলেও আগামীতে কর্মকাণ্ড দেখে আস্থাশীল হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইভিএমে আগে-পরে ভোট করার সুযোগ নেই। ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট হলে, অন্তত আমরা ১৫০ আসন সেভ করলাম। অর্থাৎ ৩০০ আসন ঝুঁকিতে থাকল না। ১৫০ আসন ঝুঁকিতে থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা যেখানে ঝুঁকি মনে করব সেখানে ফোর্স বেশি দেব। তিনি বলেন, ৩০০ আসনে যদি ব্যালটে ভোট করি তবে অবশ্যই রিস্ক বেশি। আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এমনও হতে পারে আমরা ৩০০ আসনে এক দিনে ভোট করব না। এক্ষেত্রে একাধিক দিনে ভোট হবে।
নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, পরিকল্পনা ধরেই এগিয়ে যাব আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান জানান, অংশীজন সবার সহযোগিতা দরকার। বাস্তব ও সময়ভিত্তিক এ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে।
রোডম্যাপে সাত করণীয় : সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ; নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ; বিধি মেনে ভোট কেন্দ্র স্থাপন; নতুন দল নিবন্ধন ও নিবন্ধিতদের নিরীক্ষা; সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ; নির্বাচনে অধিকতর প্রযুক্তির ব্যবহার; পর্যবেক্ষণ সংস্থা নিবন্ধন ও নবায়ন।
ইভিএম ব্যবহার ও সিসি ক্যামেরা : প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা রাখার কথা বলা হয়েছে ইসির কর্মপরিকল্পনায়। ইভিএম ব্যবহার করা হবে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে। সেক্ষেত্রে কেবল মহানগর এবং জেলা সদরের আসনগুলাতে ভোট হবে ইভিএমে। নির্বাচনের পথে ইসির সামনে ১৪টি চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের ১৯টি উপায় নিয়ে বলা হয়েছে রোডম্যাপে। ভোটের আগের কাজের সূচিও প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে।
সংসদ নির্বাচনে কখন কী করবে ইসি : আইন সংস্কার- আগস্ট ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সংলাপ- মার্চ ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২২। সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস- জানুয়ারি ২০২৩ থেকে জুন ২০২৩। প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা তৈরি- আগস্ট ২০২২ থেকে আগস্ট ২০২৩। নতুন দল নিবন্ধন- সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে জুন ২০২৩। ভোটার তালিকান্ড মে ২০২২ হালনাগাদ শুরু; মার্চ ২০২৩ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ; তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সংসদীয় আসন অনুযায়ী ৩০০ এলাকার তালিকা প্রস্তুতি করা। ভোট কেন্দ্র নির্ধারণ- জুন ২০২৩ থেকে ২০২৩ আগস্ট; তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট প্রকাশ। প্রশিক্ষণ- ২০২৩ জানুয়ারি থেকে তফসিল ঘোষণার পরও চলবে। পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন- জানুয়ারি ২০২৩ থেকে আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত।
নির্বাচনের পথে ১৯ চ্যালেঞ্জ : নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি; নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন; ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি; অর্থ ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ; নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ; নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপক্ষ/প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী/সমর্থক/পুলিশ/প্রশাসনের মাধ্যমে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া; জাল ভোট/ ভোট কেন্দ্র দখল/ব্যালট ছিনতাই রোধ; প্রার্থী/এজেন্ট/ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে অবাধ আগমন নিশ্চিত করা; ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা; নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া; পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন; পর্যাপ্ত সংখ্যক নির্বাহী/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত করা; নিরপেক্ষ দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োজিত করা।
চ্যালেঞ্জ উত্তরণের ১৯ উপায় : বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশ জন করেছেন তা বাস্তবায়ন; সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচার করতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখা; সরকারের কোনো সংস্থার হয়রানিমূলক মামলা না করা; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থক দ্বারা প্রার্থী, সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ না করা; এমন হলে আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ; নির্বাচনের আগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া; মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন, জননিরাপত্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার ও ভিডিপির প্রধানদের সঙ্গে সভা করে তাদের অধীন কর্মকর্তা যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন, তারা যেন আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন সে বিষয়ে অধীনস্তদের নির্দেশ দেওয়া; প্রত্যেক ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন; ভোট কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন; ইভিএমের ব্যবহার ১৫০ আসনে সীমাবদ্ধ রাখা; কেবল মেট্রোপলিটন ও জেলা সদরের আসনগুলোতে ব্যবহার করা; নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন; নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ, ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ; আরপিও ও নির্বাচনী আচরণ-বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা; রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যতদূর সম্ভব নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া; রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই শুরু করা, যাতে যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়; যেসব প্রিসাইডিং/সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের বিষয়ে প্রার্থীর যুক্তিসঙ্গত আপত্তি থাকবে, তাদের নিয়োগ না দেওয়া; দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং তাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা; গণমাধ্যম কর্মী নিয়োগ ও তাদের জন্যও ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করা; নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কর্মকর্তার অনীহা দেখা গেলে, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা; প্রার্থীদের জনসভা করার জন্য স্থান, তারিখ, সময়সূচি তৈরি করে দেওয়া।