ডেস্ক নিউজ
নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠন হিজবুত তাহরিরের অপতৎপরতা রোধে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ এই সংগঠনে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্তের পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ কর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠন হিজবুত তাহরির ফের অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। খেলাফত শাসন কায়েমের লক্ষ্যে সংগঠনটির বড় টার্গেট এখন দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠগুলো। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঘিরে তারা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থী ও কতিপয় শিক্ষককে দলে ভেড়ানোর ঘটনাকে অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এ কাজে প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ ও পোস্টারিংয়ের পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরম। সব ধরনের প্রচারে খেলাফত আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে তারা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘সংগঠনটির অপতৎপরতার প্রতি আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও কারা, কী উদ্দেশ্যে ফের দল পাকানোর চেষ্টা করছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। জড়িত অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টাও চলছে। গ্রেফতার হওয়া অনেকেই জামিনে বেরিয়ে ফের তৎপর হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।’ এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘নিষিদ্ধ এই সংগঠনের অপতৎপরতা রোধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতের জন্য অন্যরা সতর্ক হবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে ও লিফলেট দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শাহবাগ এলাকা ছাড়াও রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসাবে পরিচিত ধানমন্ডি, উত্তরা, রমনা, বাণিজ্যিক এলাকা কাওরান বাজার, পান্থপথ, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডা এলাকায় সংগঠনটির পোস্টার চোখে পড়েছে। এসব এলাকায় দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটানো আছে অসংখ্য পোস্টার। তাতে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে-‘হে মুসলিমগণ, বর্তমান জুলুমের শাসন অপসারণ করে খিলাফতে রাশিদাহ প্রতিষ্ঠা করার কাজে যোগ দিন।’ এমন প্রচারণা ছাড়াও অনলাইনে সম্মেলনসহ নিজেদের মধ্যে সাপ্তাহিক সভাও করছেন সংগঠনের কর্মীরা।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, প্রকাশ্যে নয়, গভীর রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা বিভিন্ন এলাকার দেওয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছে। টহল পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা এ কাজ করছে। অতীতে পোস্টার লাগানোর সময় দলটির কর্মীরা পুলিশের হাতে গ্রেফতারের নজিরও আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংগঠনটির অনলাইন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ৩ ডিসেম্বর। সম্মেলনের শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল ‘পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পতন ঘণ্টা।’ এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘স্ট্যান্ড ফর খলিফা’ নামের পেজ থেকে প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন মুক্তমনাদের অনেকেই।
বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরামের (বোয়াফ) সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময় জানান, অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ফের দল গোছানোর কাজ করছে। তাদের তরফ থেকে বিষয়টি বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিষিদ্ধ এ সংগঠনের সদস্যরা ফের দল গোছানোর চেষ্টা করছে এটা সত্য। তবে তাদের সাংগঠনিক তেমন কোনো শক্তি নেই। তারা প্রকাশ্যে আসতে পারবে না। অনলাইন প্ল্যাটফরমে তৎপরতা ও পোস্টারিং করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে না এলেও মাঠে থাকা কর্মীরা প্রকাশ্যেই নতুন করে দল গোছানোর কাজ করছে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও কয়েকজন শিক্ষকের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। সমন্বয়কারীদের পরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়েছেন তারা। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দীন সংগঠনটির শীর্ষ নেতা ছিলেন। দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকার পর তিনি জামিনে বেরিয়েছেন। প্রকাশ্যে তার তৎপরতা না থাকলেও ‘কমন একটি কাঠামো’ এখন সংগঠনটি পরিচালনা করছে। যারা সংগঠনটি পরিচালনা করছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে গোয়েন্দারা। এ কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কর্মীদেরও কাজে লাগাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘গত মাসেও অভিযান চালিয়ে হিজবুত তাহরিরের যেসব সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে চারজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংগঠনিক তৎপরতার নানা তথ্য দিয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার জন্য অশনিসঙ্কেত। ‘ক্লাস্টার’ সিস্টেমে তাদের কাজ চলায় এক সেলের সদস্যরা আরেক সেলের সদস্যদের চেনে না। তবে সমন্বয়কারীদের বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেছে।’
নিষিদ্ধ সংগঠনে শিক্ষার্থীদের জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানী যুগান্তরকে বলেন, ‘নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনে কোনো শিক্ষাথী জড়াবে না-এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এপরও যদি কেউ জড়িয়ে যায় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রচলিত আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সার্বিক সহায়তা দেবে। আর কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়ানোর যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হিজবুত তাহরিরের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে এলিট ফোর্স র্যাব গোয়েন্দারাও। তাদের অভিযানে সংগঠনটিতে সক্রিয় কর্মীরা ধরাও পড়ছে। জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, ‘নিষিদ্ধ সংগঠনটি নতুন করে সদস্য সংগ্রহের কাজ করছে। হামলা বা নাশকতার পর্যায়ে কাজ করার অবস্থা তাদের নেই। বর্তমানে সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় ৪০-৫০ জনকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি।’