- ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে
- অবকাঠামো ও সেবা খাতে বিনিয়োগ হবে বেশি
- বাণিজ্যমন্ত্রী-সচিবকে জেট্রোর চিঠি ষ দুই পক্ষের মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠকের উদ্যোগ
- জেট্রো-চট্টগ্রাম চেম্বারের মধ্যে ২২ নবেম্বর সমঝোতা স্মারক
এম শাহজাহান ॥ বাংলাদেশে আগামী দশ বছরের বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছে জাপান। ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের কোন খাতে তারা কত বিনিয়োগ করবে এর একটি কর্মকৌশল ঘোষণা করবে শীঘ্রই। অবকাঠামো ও সেবা খাতে আসবে বেশি বিনিয়োগ। এমন তথ্য জানিয়ে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন জেট্রো বাংলাদেশ প্রধান ইউজি আন্ডো বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। দশ বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে বলেও চিঠিতে আশা প্রকাশ করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পর থেকেই জাপান বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে আসছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তৎকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালে জাপান ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল জাপান সরকার। এরপর থেকে দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় সহায়তাদানকারী দেশগুলোর মধ্যে জাপান সর্বোচ্চ দাতা দেশ। গত পাঁচ বছরে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য বেড়েছে ৫ গুণ এবং সরাসরি ১১ গুণ বিনিয়োগ বেড়েছে। যা অন্য কোন দেশের সঙ্গে করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আমদানি-রফতানি বাণিজ্যেও জাপান বড় অংশীদার হয়ে উঠছে। গত ২০১৯ সালে জাপানে রফতানি হয়েছে ১২০ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে ১২৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। দেশটিতে পোশাক রফতানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আর এ কারণে রফতানি বাণিজ্য বাংলাদেশের অনুকূলে আসবে বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি জাপানী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ওই সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। জাপান বাংলাদেশর সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আরও বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করলে জাপানে রফতানি বাড়বে।
জানা গেছে, জেট্রো প্রধানের চিঠিতে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবামূলক খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সকল উন্নয়নে জাপান সহায়তা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সহায়তা আরও বাড়াবে জাপান। দীর্ঘ ৫০ বছরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও কিভাবে এগিয়ে নেয়া সে লক্ষ্যে কাজ করছে জেট্রো। এ কারণে সরকারের ভিশনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে ২০২১-২০৩০ সাল অর্র্থাৎ আগামী ১০ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ‘জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক’ শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছে জেট্রো। জাপানের বড় এই অর্থনৈতিক সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রধান ইউজি আন্ডো নিজে উদ্যোগী হয়ে আগামী দশ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। আগামী ২২ নবেম্বর জেট্রো ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
জানা গেছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সস্তা শ্রমের মতো চার কারণে জাপানী বড় বিনিয়োগের গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। চীন থেকে সরে এদেশে বিনিয়োগ করলে জাপান সরকারের কাছ থেকে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন দেশটির শিল্পোদ্যোক্তারা। জাপান গাড়ি তৈরির নিজস্ব কারখানা বাংলাদেশে করার ঘোষণা দিয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাপান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ-জাপান পাবলিক প্রাইভেট জয়েন্ট ইকোনমিক ডায়ালগ (পিপিইডি) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ বা পিপিইডি বৈঠকের পর আগামী বছরের শুরুতে জাপানী বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসবে। জাপানী বিনিয়োগ হলে দেশের অর্থনীতির চাকা যেমন গতিশীল হবে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ভূ-রাজনীতি ও করোনা সঙ্কটের কারণে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান। জাপানের বিনিয়োগকারীরা এখন চীন ছেড়ে অন্য দেশে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিনিয়োগের উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বারের মতো গত ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দায়িত্ব নেয়ার পর জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের মেগা প্রকল্পে সরাসরি জাপান বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশে ৩০০ জাপানী কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছে। এক দশক আগেও দেশে মাত্র ৮২ টি জাপানী কোম্পানি কাজ করত।
জাপানী বিনিয়োগের হাতছানি ॥ করোনা সঙ্কটের মুখে বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাসের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব না হলে অনেক কারখানা টিকতে পারবে না। এ অবস্থায় চীনের মতো শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের কারণে ভূ-রাজনীতিতে চাপে রয়েছে চীন। এসব কারণে জাপান নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সস্তা শ্রমের কারণে জাপানী বড় বিনিয়োগের গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। মূলত এই চার কারণে জাপানী বিনিয়োগের হাতছানি দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বিদেশী বিনিয়োগে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ-জাপান পাবলিক প্রাইভেট জয়েন্ট ইকোনমিক ডায়লগের (পিপিইডি) বৈঠকে বাংলাদেশে জাপানী বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওই আলোচনার পর জরুরী ভিত্তিতে সমাধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে বিডার কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জাপানী কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ চীন থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আকর্ষণীয় করে তুলতে জাপানী বিনিয়োগকারীদের উত্থাপিত বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য বিভিন্ন সরকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বিডা। তিনি বলেন, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের খুশি করতে ও নতুন বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করার জন্য বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ॥ জাপানী বড় বিনিয়োগ হবে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চলে। এখানে জাপানী উদ্যোক্তারা কারখানা করে পণ্য উৎপাদন করবেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার উপজেলায় জাপানী বিনিয়োগে এককভাবে এক হাজার একর অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) তৈরি করা হচ্ছে। সরকার টু-সরকার উদ্যোগে এটি বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল। জাপানী রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও জাপান বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার চিন্তা করছে। এজন্য এফটিএ অথবা পিটিএ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। এগুলোতে জাপান বিনিয়োগ করলে লাভবান হবে। এখানে বিনিয়োগে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।