ডেস্ক নিউজ
এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের পর এবার সব ধরনের পণ্য রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে জোরেশোরে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ এলডিসি দেশের ন্যায় শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাবে। তবে এই সময়ের মধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। শ্রমমান ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭ শর্ত পরিপালনে সক্ষম হলে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। বাংলাদেশ-ইইউ যৌথ বাণিজ্য কমিশন জিএসপি প্লাস সুবিধার বিষয়ে শীঘ্রই একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম অধিকার ও কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া এ্যাকশন প্ল্যানের ১৬ শর্ত পূরণ করা হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারির শতাধিক কমপ্লায়েন্স কারখানা স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশে। এরই ধারাবাহিকতায় জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়ে সকল শর্ত পূরণ করা হবে।
জানা গেছে, স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির পর আগামীতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মানুযায়ী ২০২৭ সালের পর সব ধরনের পণ্য রফতানিতে জিএসপি বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা আর থাকছে না। এছাড়া সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সঙ্কুচিত করবে দাতা সংস্থাগুলো। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ¦ল হওয়ার পাশাপাশি বড় অঙ্কের বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হওয়ার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন বড় ঋণপ্রাপ্তি সহজ হবে। তবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত।
এলডিসি দেশ হিসেবে ইইউর অধিভুক্ত ২৮টি দেশে এখন শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা বহাল রয়েছে। দেশের ৩০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির ২০ বিলিয়ন ডলার রফতানি হচ্ছে ইইউতে। উদ্যোক্তাদের মতে, ইইউর বাজারে সবার আগে জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায় করতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকৃত পণ্য চামড়ারও বড় বাজার ইইউ। এছাড়া মৎস্য, কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের নানা পণ্য রফতানি হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এটা যেমন গৌরব ও সম্মানের ঠিক তেমনি আমাদের সামনে কিছু ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। এ কারণে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে ইইউভুক্ত দেশে রফতানির ক্ষেত্রে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত না হলে দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে জোরেশোরে কাজ করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে। ইইউ’র শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হবে।
জানা গেছে, পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ইইউ অব্যাহত শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম অবাধ এবং শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত রেঞ্জি তেরেগ্ধিক। এসব পদক্ষেপের মধ্যে আছে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অগ্রগতি ধরে রাখা এবং সংশোধিত শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। ডব্লিউটিওর নিয়ম অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর উন্নত দেশে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম হিসেবে ইইউতে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) নামের স্কিমে বর্তমান এই শুল্কমুক্ত সুবিধা অতিরিক্ত ৩ বছর অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ ২০২৭ সালের পর আর ইইউর দেশে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। এ কারণে জিএসপি প্লাসই এখন মূল ভরসা।
জানা গেছে, জিএসপি প্লাস সুবিধার বিষয়ে বাংলাদেশ এবং ইইউর একটি যৌথ কমিশন কাজ করবে। এই কমিশন ইইউ আরোপিত ২৭ শর্ত পরিপালনে সহযোগিতা করবে। কমিশনের উদ্যোগে একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হবে। আর এক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে শ্রম মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএলও, বাংলাদেশ পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
শ্রম অধিকার রক্ষা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুকরণ, শ্রম আইনের বাস্তবায়ন, যথাসময়ে বেতন ও পেনশন সুবিধা দেয়া, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিকরণসহ ২৭টি শর্ত আরোপ মানতে হবে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য জিএসপি প্লাস যেমন দরকার একই সঙ্গে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া সহজ হবে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তিনি বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিকরণে শ্রম আদালত বাড়াতে হবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় দেশের আইনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস সুবিধার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত হতে পারলে শুল্ক অব্যাহতি থেকে শুরু করে নানা ধরনের সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ২৭টি মানবাধিকার ও শ্রমমান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক রীতি মানতে হবে, যার মধ্যে ১৫টি আইএলওর শ্রমমানের সঙ্গে সম্পর্কিত।