পদ্মা বহুমুখী সেতু চালুর পর দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার হবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আঞ্চলিকসহ সারা দেশের অর্থনীতিতে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে মানুষের চলাচল বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বাড়বে পণ্যের সরবরাহ, উৎপাদন, পর্যটকদের আনাগোনা। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। গতি আসবে নতুন কর্মসংস্থানে। অর্থনৈতিক লেনদেনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার। কমে আসবে দারিদ্র্য। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্যও হ্রাস পাবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করেছে।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ সংশোধিত ব্যয় অনুযায়ী সেতু নির্মাণে মোট খরচ হবে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আগামী বছরের ২১ জুনের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। পদ্মা রেল সেতুর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর সময়সীমা আরও বাড়তে পারে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সেতুর উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হতে পারে। পদ্মা সড়ক সেতুতে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হবে তার বিপরীতে মুনাফার হার বছরে দাঁড়াবে ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে সাধারণত বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হার ১৫ শতাংশ। পদ্মা সেতুতে এ হার বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে-এটি বহুল ব্যবহৃত একটি অবকাঠামো হবে। যে কারণে এ থেকে রাজস্ব আয় ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সেতুকে কেন্দ্র করে এপারে এবং ওপারে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাব। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। যা মানুষের জীবনমানকে আরও উন্নত করবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারা দেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ৩২ লাখ কোটি টাকা। এ হিসাবে সেতুর কারণে জিডিপিতে বাড়তি জোগান হবে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে বাড়বে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ। ফলে জাতীয়ভাবে বাড়বে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এভাবে জিডিপির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সেতুর অবদানও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো বড় অবকাঠামা সরকারকেই করতে হয়। সরকারের হাত ধরে সেখানে বেসরকারি খাত এগিয়ে যায়। পদ্মা সেতুর ফলে ওপারে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার হবে। যোগাযোগ অবকাঠামোতে যে সুবিধা হবে, এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে বড় সহায়ক হবে।
পদ্মার ওপারে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলা, ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, পোপালগঞ্জ জেলাসহ মোট ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষ এ সেতুর ফলে সরাসরি উপকৃত হবে। বদলে যাব দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনৈতিক চিত্র। এর ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পদ্মার ওপারে বিনিয়োগের ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। গার্মেন্ট, পাট, হিমায়িত খাদ্য, পর্যটন শিল্পে বিনিয়াগের দুয়ার খুলে যাবে।
পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিনদিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোলস্থল বন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। এতে রফতানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের চলাচল বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত।
সেতুর মাওয়া অংশ থেকে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে। এভাবে সারা দেশে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের মধ্যে খুলনা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে মোট আমানতের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের সাড়ে ৪ শতাংশ। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে ওপারে বিনিয়াগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে, তখন ঋণের প্রবাহও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশি সচল হবে এবং নতুন নতুন খাত যুক্ত হলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন সঞ্চয়ও বাড়বে, যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মা সেতু চালু হলে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ৩৫ হাজার। এ থেকে রাজম্ব আয় হবে ৮২২ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ৩৯ হাজারে দাঁড়াবে। রাজস্ব আয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৫৮ হাজারে যানবাহন চলবে। রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০৩৫ সালে তা আরও বেড়ে ৬৬ হাজার যানবাহন এবং রাজস্ব আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০৫০ সালে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে ৭৬ হাজার। রাজস্ব আয় বাড়বে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
সেতুর করণে যোগাযোগ অবকাঠামো বাড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও গতি আসবে। বিশেষ করে আন্তঃদেশীয় পণ্য আমদানি-রফতানিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। মোংলা বন্দর আরও সচল হবে। পায়রা বন্দরের গুরুত্ব বাড়বে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে নদীর ওপারে বিনিয়োগ বাড়বে, দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য দ্রুত সারা দেশে পৌঁছানো সম্ভব হবে।