চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ ২০০৭ সালে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণ হলেও যন্ত্রপাতি এবং পরিচালন জটিলতায় নির্মাণের প্রায় ৮ বছর পর সেটি চালু হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে। এনসিটি নির্মাণের পর গত ১৩ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে যোগ হয়নি নতুন কোনো জেটি কিংবা টার্মিনাল। অথচ বন্দরের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে প্রতি বছরই। পণ্য ওঠা-নামার প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে কখনো কখনো হিমশিম খেতে হলেও বিদ্যমান সামর্থ্য দিয়েই চলছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুই বছর আগে গ্যানট্রি ক্রেন, কনটেইনার মুভারসহ বেশ কিছু নতুন ইকুইপমেন্ট যুক্ত হলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় সীমিত। এ অবস্থায় দ্রুত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) নির্মাণে হাত দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কাজ শুরু করে গত বছরের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিকূল পরিবেশে এখনো কাজ শেষ হয়নি। তবে কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে আবারও সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পিসিটিতে চারটি জেটি দ্রুত নির্মাণ শেষ করে সংকট সামাল দিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। নির্মাণ শেষে চার জেটিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোগ করা হলে এই টার্মিনালে বছরে ৪ লাখ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। টার্মিনাল পরিচালনা নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে যন্ত্রপাতি কিনে পরিচালনার কথা থাকলেও এখন বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত অপারেটর নিজস্ব ব্যয়ে যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনালটি পরিচালনা করবে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ২০২১ সালের জুন থেকেই আমরা এই চারটি জেটিতে সাধারণ পণ্যের জাহাজ ভেড়াতে পারব। এতে বন্দরের মূল জেটির ওপর পণ্য ওঠা-নামার চাপ কিছুটা কমবে।
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে টার্মিনালের ভিতর দিয়ে যাতে বিমানবন্দরমুখী গাড়িগুলো দ্রুত যাতায়াত করতে পারে সেজন্য ৪২০ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আরও দুটি লেনও রাখা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির প্রথম ধাপে কাজের গতিতে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও এখন পুরোদমে কাজ চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি বড় প্রকল্প। ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে বন্দরের নিজস্ব তহবিলের সাড়ে ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ২০১৯ সালেই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করে মুজিববর্ষে টার্মিনাল অপারেশনে যাওয়ার কথা থাকলেও সময়ের হিসাবে কাজ এগিয়েছে মাত্র ৬০ শতাংশ। কাজের ধীরগতি এবং করোনা পরিস্থিতি এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ পিছিয়ে দিয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম জানান, মুজিববর্ষে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কাজ শেষ করে অপারেশনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সব ধরনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। সেই প্রভাবে এই টার্মিনালের নির্মাণকাজও বাধাগ্রস্ত হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৭০-৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে এবং ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই টার্মিনালটি অপারেশনে যেতে পারবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে।
বন্দর সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ বুঝে না পাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারেনি। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। পরে ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর কাছে প্রকল্পের কাজ হস্তান্তর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেনাবাহিনী প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এতে প্রকল্পের কাজ শুরু করতেই ৬ মাস অতিরিক্ত লেগে যায়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে রয়েছে ৩২ একর জায়গায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ জেটি। যেখানে ৩টি জাহাজ বার্থিং করতে পারবে। এ ছাড়া থাকবে ২২০ মিটার দীর্ঘ একটি ডলফিন জেটি। ১ লাখ ১২ হাজার বর্গমিটার অভ্যন্তরীণ ইয়ার্ড এবং রাস্তা। এ ছাড়া ২ হাজার ১২৮ বর্গমিটার কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন শেড (সিএফএস), ৬ মিটার উচ্চতার ১৭৫০ মিটার কাস্টমস বন্ডেড ওয়াল, ৫৫৮০ বর্গমিটার পোর্ট অফিস বিল্ডিং, ১২০০ বর্গমিটার যান্ত্রিক ও মেরামত কারখানা, ২৫০০ মিটার রেলওয়ে ট্রেক নির্মাণ, ৪২০ মিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ, চার লেনবিশিষ্ট শূন্য দশমিক ৭৫ কিমি. এবং ছয় লেনবিশিষ্ট ১ কিলোমিটার আগের রাস্তা স্থানান্তর করে পুনর্নির্মাণ, সিকিউরিটি পোস্ট, গেস্ট হাউস, ফুয়েল স্টেশন এবং লেবার শেড। এ ছাড়া টার্মিনাল পরিচালনা কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে থাকবে ২টি ফায়ার ট্রাক, ১টি ফায়ার কার, ৩টি নিরাপত্তা পেট্রোল কার, ১টি আম্বুলেন্স, ৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, ৪টি স্ট্রাডেল কেরিয়ার, ৪টি রিচ স্ট্যাকার, ৮টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি), ৪টি লো-মাস্ট ফর্ক লিফট, ৪টি ফর্ক লিফট, ১টি রেইল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরএমজি), ২টি টাগ বোট, ২টি পাইলট বোট এবং ২টি ফাস্ট স্পিডবোট। ২৫০০ মিটার রেলওয়ে ট্রেক নির্মাণ করা হবে। রেললাইনটা সংযুক্ত থাকবে সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ডের সঙ্গে। ইতিমধ্যে ১০ একর জায়গায় কনটেইনার ইয়ার্ড হয়েছে। সঙ্গে আরও ৬ একর জায়গায় ঠিকাদারকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে কাজ করার জন্য। এই ১৬ একর জায়গায় রেললাইন সংযুক্ত থাকবে পিসিটির সঙ্গে। ফলে জাহাজ থেকে নামিয়ে কনটেইনার কম সময়েই বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পণ্য/কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে পিসিটি নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থা পিসিটির অপারেটর (পরিচালনা) কাজের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের লক্ষ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করতে সময়সূচি ও অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও চবকের সমন্বয়ে একটি প্রজেক্ট টিম গঠন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।