ডেস্ক নিউজ
দেশে কয়েক দিন ধরে দিনে-রাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। এতে একদিকে জনজীবন যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পোৎপাদন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে, গতকাল সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে দেশে মোট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৩০১ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ১৩ হাজার ৫১ মেগাওয়াট। ঘাটতি ২৫০ মেগাওয়াট। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার। সেপ্টেম্বরের আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলেও গতকাল সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আর বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপের কথাও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি বিভাগ এবং উৎপাদন, বিতরণ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এ কথা বলেন। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারের তরফ থেকে কী ধরনের নির্দেশনা আসতে পারে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সাশ্রয়ী হতে নিজ নিজ ঘরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। সরকারি-বেসরকারি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ যেসব জায়গায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আছে সেখানে ২৫ ডিগ্রির নিচে যন্ত্রটি চালানো যাবে না। ঈদ, বিয়ের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন উৎসবে যে আলোকসজ্জা করা হয় তা করা যাবে না। বিয়েসহ বিভিন্ন ধরনের যে সামাজিক অনুষ্ঠান রাতে হয় তা সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করা হলে কীভাবে আগে থেকে গ্রাহককে জানানো যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের তথ্য গ্রাহকদের জানানোর কথা ভাবা হচ্ছে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এরই মধ্যে লোডশেডিংয়ের তথ্য জানাতে একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। সেটি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব কোম্পানিকে ডেভেলপ করতে বলা হয়েছে। যারা মাঠপর্যায়ে রয়েছেন তারা এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবেন। এজন্য মাঠপর্যায়ের কমিটিগুলোকে আরও শক্তিশালী করার চিন্তাভাবনা চলছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কেন্দ্রীয়ভাবে যে মনিটরিং টিম আছে সেগুলোকে শক্তিশালী করার কথা ভাবা হচ্ছে। করোনাকালে যেভাবে অফিস সময় সংশোধন করা হয়েছিল, অর্থাৎ সময় কিছুটা কমিয়ে আনার ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে। পিক আওয়ারে আগে অফিস শেষ করতে হবে। অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে শেষ করতে হবে। আবার ঘরে বসে কাজ করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। এগুলো করতে পারলে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। যারা বেইআইনিভাবে জ্বালানি ব্যবহার করছেন, অর্থাৎ বিদ্যুতের বিল যারা পরিশোধ করছেন না, তাদের আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। এসব বিষয় নিয়ে গতকাল জরুরি বৈঠকে সংশ্লিষ্টরা আলোচনা করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য এসব প্রস্তাব পাঠানো হবে।’ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতির হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা চলছে। সেপ্টেম্বরের পর রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এস আলম গ্রুপের বাঁশখালীর বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন কমে এলেও সমস্যা হবে না। শুধু এলএনজি দিয়ে সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। এ ছাড়া রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধের ব্যাপারে ঈদের পর থেকে কঠোর হওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘জ্বালানি সংকটের কারণে এ মুহূর্তে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। আমরা যদি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে পারি তাহলে ঘাটতি ৫০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা সম্ভব। ধারণা করছি, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে এ চাহিদা সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াটে নামিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।’ বর্তমানে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, ‘২০২৫ সাল নাগাদ ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সঞ্চালন লাইনের কোন কোন স্থান থেকে গ্যাস চুরি হচ্ছে তা কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করছে। এসব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্যাস চুরি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যে এলএনজি আমরা একসময় ৫ ডলারে পেয়েছিলাম, তা ৪১ ডলার পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহনশীল মূল্যবৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। দাম সহনশীল পর্যায়ে বাড়ানোর পরও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে ভর্তুকি, তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। প্রণোদনাসহ বিভিন্ন অনুদানে সরকারের চাপ আছে। আর সে চাপ যে চলে গিয়েছে তা বলা যাবে না। সুতরাং আমাদের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের যে ঘাটতি তা যে এখানেই শেষ বলা যাচ্ছে না। এটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হবে।’
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সারা দেশে আলোকসজ্জা বন্ধ : বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে সব ধরনের আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন ও সংযোগ অধিশাখার উপসচিব সাইফুল ইসলাম ভুইয়ার সই করা এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আলোকসজ্জা না করার নির্দেশ দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়- বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিং মল, দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জা না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।