ডেস্ক নিউজ
করোনা ভাইরাসের টিকা কিনতে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা সংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই অর্থ সংগ্রহে দাতা সংস্থার সহায়তার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে সরকার। এছাড়া আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও টিকা কিনতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পাঁচ ধাপে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসের বিনামূল্যের টিকা পাবেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ধাপের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। টিকার প্রাথমিক সফলতায় দেশের সাধারণ মানুষ এখন এই ভ্যাকসিন নিতে এগিয়ে আসছে। বাড়ছে টিকা গ্রহণে আগ্রহী নিবন্ধনকারীর সংখ্যা। এতে করে করোনাভীতি দূর করে সাধারণ জনগণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আবার ফিরে আসছেন। ফলে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি এই টিকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এখন অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ শুরু করেছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর নিকট অর্থায়নের অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া করোনার টিকা কিনতে অর্থ বিভাগ বাজেট থেকে ১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক টিকা ক্রয়ে আরও ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার সমান ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা ধরে) দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যা দিয়ে দেশের আরও ৩১ শতাংশ জনগণ টিকার আওতায় আসবে। বাকি ৪০ শতাংশ নাগরিকে টিকার আওতায় আনতে উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইআরডি।
দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান সম্ভব না হলে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, টিকা নিতে সক্ষম এরকম প্রতিটি নাগরিককে সরকার করোনার টিকা দিবে। এলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের উদ্যোগ রয়েছে। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতে করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে। আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? আমাদের দেশের সবার করোনার টিকা নেয়া উচিত। করোনার কারণে সারা বিশ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। একটি খারাপ সময় পার করছে বিশ্ববাসী। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে টিকার কোন বিকল্প নেই।
জানা গেছে, সম্প্রতি করোনার টিকা ক্রয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে সভা করেছেন। ওই সভার কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে জাতীয় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের মোট জনগণের ৮০ শতাংশকে ভ্যাকসিন তথা টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে টিকাদান কার্যক্রমের প্রথম ধাপ চলছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’র তিন কোটি ডোজের প্রয়োগে প্রায় ৯ শতাংশ নাগরিক টিকার আওতায় আসবে। এ জন্য অর্থ বিভাগ বাজেট থেকে ১ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। দেশের সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনতে ভ্যাকসিন ক্রয় ও অপারেশনাল কস্ট বাবদ ১ হাজার ৬৭২ মিলিয়ন ডলার বা ১৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। তবে ভ্যাকসিনের দাম কম বা বাড়ার ওপর এ টাকার পরিমাণ নির্ভর করবে। বড় অঙ্কের এই অর্থ সংস্থানে দাতা সংস্থাগুলোর কাছে অর্থ সহায়তা চাওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে না আসে তাহলে ভ্যাকসিন ক্রয়ে সরকার বাজেট থেকে টাকা দেবে। বর্তমানে বাংলাদেশকে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা বা ঋণ দিতে চাচ্ছে। তাই সরকার তাদের নিকেট থেকে সহায়তা গ্রহণের চেষ্টা করছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকার করোনার টিকা কিনা ও এ সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি ক্রয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছে। আগামী বাজেটেও করোনার টিকা কিনতে থোক বরাদ্দ দেয়া হবে।
টিকা কিনতে দাতা সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে ॥ করোনার টিকা কিনতে জাপান সরকার (জাইকা) স্বাস্থ্য সেবা বা শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ৩০০ থেকে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার তথা ২৮৪৪ থেকে ২ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা ঋণ (বাজেট সাপোর্ট) চাওয়া হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক গঠিত ‘এশিয়া ভ্যাকসিন এ্যান্ড ফ্যাসিলিটি’ তহবিল হতে ভ্যাকসিন ক্রয় ও স্বাস্থ’্য সেবা ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জাইকার বাজেট সাপোর্টের আওতায় ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে কিছু এ্যাকশন প্ল্যান চূড়ান্ত করতে হবে। পাশাপাশি অর্থ ছাড়ের পূর্বে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কিছু ‘পলিসি এ্যাকশন’ অর্জন করতে হবে। সম্প্রতি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এদিকে প্রথমবারের মতো ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এএফডি) স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব উৎসসমূহ থেকে প্রয়োজনীয় ৪০ শতাংশ নাগরিকের জন্য টিকার অর্থ মেটানো সম্ভাব। বাজেট সাপোর্টের আওতায় প্রদত্ত সহায়তা সরাসরি অর্থ বিভাগ পাবে। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্ধারিত পলিসি এ্যাকশন বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে প্রয়োজনানুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বস্বাস্থ্য) কাজী জেবুন্নেছা বেগম বলেন, প্রতিটি অর্থায়নই উন্নয়ন সহযোগী থেকে ঋণ হিসেবে প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খারূপে বিশ্লেষণ করে নেয়া প্রয়োজন।
পাঁচ ধাপে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ টিকা পাবেন ॥ পাঁচ ধাপে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হবে। তিন ভাগে মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’র তিন কোটি ডোজ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে টিকাদান কার্যক্রম শুর হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ গত ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এর আগে ২১ জানুয়ারি ২০ লাখ ডোজ কোভিশিল্ড বাংলাদেশকে উপহার পাঠায় ভারত সরকার। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের হাতে রয়েছে ৭০ লাখ ডোজ টিকা রয়েছে। এছাড়া আর কোন ভ্যাকসিন ক্রয়ে চুক্তি করেনি সরকার। বর্তমানে টিকাদান কর্মসূচী চলমান রয়েছে।
করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে চলতি বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি জরুরী তহবিল গঠন করা হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হওয়ায় এই বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হতে পারে। সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে ভ্যাকসিন আমদানিতে। এলক্ষ্যে অর্থ সংস্থানে বিদেশী দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ সহায়তা ও অনুদান চাওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবি করোনার টিকা আমদানিতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি উত্তরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও নতুন নতুন হাসপাতাল করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। করোনা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি নির্ধারিত বরাদ্দের পরেও যদি প্রয়োজন হয় তাহলে জরুরী প্রয়োজনে সিসিইউ, আইসিইউ, আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু, সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা (সাপোর্ট কেয়ার), করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য কিট (সরঞ্জাম) এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে এ টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার হয় এমন সব পণ্য আমদানিতে শতভাগ শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পাবেন এ শিল্পের উদোক্তারা। ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে থাকছে সব ধরনের ট্যাক্স ও ভ্যাট সুবিধা। কিছু শর্ত সাপেক্ষে হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ওষুধ ও সেবা সামগ্রী সম্পূর্ণ ফ্রি দেয়া হবে। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ ও করোনা রোগের চিকিৎসা সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে আগামী বাজেটে এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে সরকার।