ডেস্ক নিউজ
বছরের প্রথম দিন ক্লাস শুরু হলে স্কুলগুলোর আলাদা একটা প্রস্তুতি থাকে। ঠিক তেমনভাবেই কাল রবিবার শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কারণ করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী, যারা নতুন ভর্তি হয়েছে তাদের জন্য কালই হবে প্রথম দিনের স্কুল-কলেজ। এ জন্যই অনেক স্কুলের ফটক সাজানো হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো স্কুল ড্রাম বাজিয়ে, করতালি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
করোনাকালে সংক্রমণ এড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তাই বড় স্কুলগুলো প্রতিটি শ্রেণিকে একাধিক ভাগে ভাগ করেছে। প্রতি বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুজন শিক্ষার্থী বসানো হবে। এ ছাড়া আগে স্কুলের কিছু গেট বন্ধ থাকলেও এবার শিক্ষার্থীদের ঢুকতে ও বের হতে সব গেটই খুলে দেওয়া হবে।
একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরা জানান, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশই টিকা নিয়েছে। তবে কর্মচারীরা কিছুটা পিছিয়ে আছেন। তাঁদের টিকা নেওয়ার হার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ৯০ শতাংশই টিকা নিয়েছে। স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দেওয়ার পর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকা নেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করেছে। এমনকি টিকা না নেওয়াদের বেশির ভাগই এরই মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তবে টিকা নেওয়ার এসএমএস না আসায় অনেকেই টিকা নিতে পারছেন না। কোনো কোনো স্কুল কর্তৃপক্ষ টিকা না নেওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কুলে আসতে নিষেধ করেছে। অবশ্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর কঠোর মনিটর করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। এরই মধ্যে তারা স্কুল-কলেজকে নির্দেশনা দিয়েছে। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে ৯ দফা নির্দেশনা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেগুলো হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে সব শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করা; শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে পারস্পরিক তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা; প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করবে এবং বাসা থেকে যাওয়া-আসা করবে, সে বিষয়ে শিক্ষণীয় ও উদ্বুদ্ধকরণ ব্রিফিং করা; আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঠিকভাবে মাস্ক (সম্ভব হলে কাপড়ের মাস্ক) পরিধান করার বিষয়টি নিশ্চিত করা; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর উপস্থিতির সংখ্যা নিরূপণ করা ও সব শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব ওয়াশরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা; কভিড-১৯ অতিমারিজনিত সরকারের স্বাস্থ্যবিধি যথাসময়ে প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ কমিটি গঠন করা।
রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে কিছু পরিকল্পনা করেছে। ক্লাসের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। বেইলি রোড, আজিমপুর, ধানমণ্ডি ও বসুন্ধরায় ভিকারুননিসার চারটি শাখার প্রবেশ পথের সব ফটক বেলুন ও জরি কাগজ দিয়ে সাজানো হবে। তিন ফুট দূরত্ব রেখে শিক্ষকরা গেটের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবেন। ছাত্রীরা যখন প্রবেশ করবে, শিক্ষকরা করতালি ও ড্রাম বাজিয়ে সংবর্ধনা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হবে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামরুন নাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ। কিন্তু বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত কোনো না কোনো কাজ থাকছেই। কালও আমাদের কিছু কাজ আছে। আমাদের শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০০ এর মতো। শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশ টিকা নিয়েছে। আর কর্মচারীদের মধ্যে এই হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি হবে। তবে সবাই মাস্ক পরা থাকবে। সব গেটই খোলা হবে। যাতে স্কুলে ঢুকতে ও বের হতে হুড়োহুড়ি না হয়।’
ডেমরার সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ক্লাসগুলোকে শিক্ষার্থী অনুসারে একাধিক ভাগে ভাগ করেছি। সরাসরি ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসও চলবে। আমাদের স্কুলের ৪টা গেট। সব দিক দিয়েই শিক্ষার্থীরা ঢুকবে ও বের হবে। বের হওয়ার সময় লাইন করে দেব। আমাদের ৪০০ শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১২ জন এখনো টিকা নেননি। তাঁদের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর স্কুলে আসতে বলেছি।’
রাজধানীর গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ৩টা গেট দিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢুকবে ও বের হবে। এ ছাড়া প্রভাতি ও দিবা শাখার প্রতিটি শ্রেণিকে দুই ভাগে ভাগ করেছি। ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে এসেছে। আমাদের ৫৪ জন শিক্ষক ও ২০ জন কর্মচারী, যাদের সবাই টিকা নিয়েছেন। তবে অস্থায়ী কয়েকজন কর্মচারী আছেন, যাঁদের সবাই এখনো টিকা নেননি। স্কুলে আসতে হলে তাঁদেরও টিকা নিয়ে আসতে হবে বলে আমরা জানিয়ে দিয়েছি।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করেছি। তবে সরাসরি ও অনলাইন ক্লাসের রুটিন করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যার মধ্যে পড়েছি। কারণ একজন শিক্ষকের পক্ষে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে আরেক শ্রেণিতে অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য অনলাইন ক্লাসগুলো আমরা সকালে ও সন্ধ্যায় রেখেছি। এ ছাড়া আমাদের তিনটি গেট আছে। সব গেট দিয়েই ছাত্রীরা ঢুকবে ও বের হবে। আমাদের ৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারী। যাঁদের দু-একজন বাদে সবাই টিকা নিয়েছেন।’
জানা যায়, বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসএমএসে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদেরও কিছু প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। যেমন—কাপড়ের একটি মাস্ক মুখে থাকলেও আরেকটি ব্যাগে রাখা, স্যানিটাইজার রাখা, পানির বোতল নিয়ে আসা ইত্যাদি। এ ছাড়া একটি শ্রেণিকে যেহেতু একাধিক ভাগে ভাগ করা হচ্ছে, তাহলে কোন শিক্ষার্থী কোন রুমে বসবে, কোন গেট দিয়ে প্রবেশ করবে, সেগুলোই আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক স্কুলই তাদের শিক্ষার্থীদের রোল নম্বরের জোড়-বিজোড়কে আলাদা ভাগে ভাগ করে পৃথক ক্লাসে বসাচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় মফস্বলের স্কুলগুলোও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। মৌলভীবাজার সদরের বাদগাঁও তাহেরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ক্লাসরুম, স্কুল আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছি। আমাদের বেঞ্চের দৈর্ঘ্য সাত ফুট। তাই এক বেঞ্চে দুজন বসাব। এরপর এক বেঞ্চ বাদ দিয়ে আরেক বেঞ্চে বসবে শিক্ষার্থীরা। আমাদের ১৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর সবাই টিকা নিয়েছেন।’
যশোর সদরের আম বটতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহসীন আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গাইডলাইন অনুসারে যতদূর সম্ভব আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা এক হাজার ৮০০ জন। সেই হিসাবে প্রয়োজনীয় ক্লাসরুমের সংকট রয়েছে। তাই আমরা প্রতি বেঞ্চে দুজন করে শিক্ষার্থী বসাব। আমাদের ৩৬ জন শিক্ষক ও সাতজন কর্মচারী। এখন পর্যন্ত দুজন কর্মচারী টিকা নিতে পারেননি।’
প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিকের শিক্ষকরা টিকা গ্রহণে এগিয়ে আছেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ১৫২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৯৩ জন শিক্ষকের মধ্যে ৭২৩ জন দুই ডোজ করে টিকা নিয়েছেন। বাকি ৭০ জনের মধ্যে ২৫ জন রেজিস্ট্রেশন করেছেন, ৪৫ জন এখনো টিকা নেননি। ময়মনসিংহের নান্দাইলে ১৭৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯৭১ জন শিক্ষকের মধ্যে টিকা নিয়েছেন ৯৪০ জন। উপজেলায় ৩৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে টিকা নিতে বাকি আছে ২৮ জন। ৩৬টি মাদরাসার ৪৫০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে টিকা বাকি আছে ২০ জনের।
সীতাকুণ্ডু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিদারুল আলম জানান, তাঁর স্কুলে শিক্ষক ২২ জন এবং কর্মচারী সাতজন। তাঁদের মধ্যে দুজন শিক্ষক বাদে সবাই টিকা নিয়েছেন। শারীরিক অসুবিধা থাকায় ওই দুই শিক্ষক টিকা নিতে পারেননি।
যশোরের বাঘারপাড়ায় মাহমুদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১৪ জন টিকা নিয়েছেন।
কভিড-১৯ মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শুরুতেই অভিভাবকদের দায়িত্বের কথা বলব। একটা বাচ্চা কিভাবে মাস্ক পরবে, কিভাবে হাত ধুতে হবে, সেগুলো শিখিয়ে দিতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা স্যানিটাইজার ব্যবহার করবে। আর থার্মোমিটার দিয়ে স্কুল গেটে তাপমাত্রা মাপার কথা বলা হলেও তা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই গা গরম থাকলে অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন না।’
ডা. মোহিত কামাল আরো বলেন, ‘যেহেতু শিক্ষার্থীরা অনেক দিন পর স্কুলে আসছে, তাই তাদের পড়ার দিকে মন নাও টানতে পারে। এ জন্য ধমক দেওয়া যাবে না, শাস্তি দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ প্রথমেই কোনো চাপ না দিয়ে ভয়কে জয় করতে হবে। এরপর শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দায়িত্ব শিক্ষকদের নিতে হবে।’