হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, যেহেতু কাজটা (চুক্তি) হয়েছে জি টু জি। ফলে আমাদের টিকা পেতে কোনো বাধা নেই। … যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে তাতে আমাদের চুক্তিতে কোনো জটিলতা তৈরি করছে না: স্বাস্থ্যসচিব
সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াকে করোনার টিকা রপ্তানিতে ভারত সরকার নিষেধাজ্ঞা দিলেও প্রতিষ্ঠানটি থেকে বাংলাদেশের টিকা প্রাপ্তিতে কোনো বাধা নেই।
ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার খবরটি সংবাদমাধ্যমে আসার পর ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার বিশ্বজিৎ দের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে টিকা নিয়ে এক জরুরি বৈঠক শেষে সোমবার ব্রিফিং করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ব্রিফিং চলাকালেই সচিবকে ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। কথা শেষ করেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে কথা বলেন সচিব আবদুল মান্নান।
‘একটি সুসংবাদ আছে’ জানিয়ে সচিব বলেন, ‘হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার বিশ্বজিৎ দের সঙ্গে কথা বলছিলেন জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আমরা যে চুক্তি করেছি, কাজটি হয়েছে জি-টু-জি, সরকার টু সরকার। এর সঙ্গে যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার কথা ভারত সরকার বলেছে শুধু কমার্শিয়াল অ্যাকটিভিটিজের ওপর, আমাদেরগুলোর ওপর নয়। কারণ আমাদেরটা সরকার টু সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথা হয়েছে। তিন কোটি ভ্যাকসিনের কথা কিন্তু উনিও (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, মানে গভর্নমেন্ট জানে।
‘আরেকটি পয়েন্ট, আমরা যখন এগ্রিমেন্ট করি ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার নিজে এখানে উপস্থিত ছিলেন। কাজেই আমাদের বিষয়টি হচ্ছে জি-টু-জি বা সরকার টু সরকার। যে নিষেধাজ্ঞা ভারত সরকার দিয়েছে, সেটা হলো- ইন্টারনাল কমার্শিয়াল অ্যাকটিভিটিস হবে না, এটা বলেছে।’
এ কারণে নির্ধারিত সময়ে টিকা আসতে কোনো বাধা আর থাকল না বলেও মনে করেন স্বাস্থ্য সচিব।
‘এতদিন সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া নিজের দেশের সরকারের কোনো অনুমোদন পায়নি, গতকাল তারা পেয়েছে। এখন তারা ডব্লিউএইচও’র কাছে আবেদন করবে।
‘যদি তিন সপ্তাহের মধ্যে ডব্লিউএইচও-এর অনুমোদন তারা নিয়ে আসতে পারে তাহলে আমাদের বলা হয়েছিল ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাব, তাহলে ফেব্রুয়ারি আসতে তো এখনও তিন-চার সপ্তাহ বাকি। কাজেই ডিলে হওয়ার কোনো অবকাশ নাই।’
আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তার আর কোনো জায়গা থাকল না বলেও জোর গলায় বলেন সচিব।
যেকোনো ওষুধ আমদানি, বিক্রি, মজুত ও মানুষের শরীরে প্রয়োগ করতে গেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। সে প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘এটিরও অনুমোদন দিয়েছি। আজ দুপুরের মধ্যে তাদের কাছ থেকে একটি চিঠি আসবে, চিঠি পাওয়ার পর অনুমোদন দিয়ে দেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আজকেই সব ধরনের ফর্মালিটিজ শেষ করেছি। যাদের কাছ থেকে ব্যাংক গ্যারান্টি পেয়েছি তাদের পেমেন্টে দেব। আজই হয়ে যাবে আশা করছি, স্যার ইতিমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন। এটি হয়ে যাচ্ছে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার যেসব টিকার প্রয়োগ হচ্ছে, সেগুলো দেশে আনতে বাংলাদেশের কোনো চুক্তি নেই। সরকার অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকাতে শুরু থেকেই আস্থা রেখে আসছে।
এই টিকা ভারতে উৎপাদনের চুক্তি আছে সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। আর তাদের কাছ থেকে তিন কোটি টিকা নিতে গত ৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ।
চুক্তিটি ছিল ত্রিপক্ষীয়, আর একপক্ষ বাংলাদেশ সরকার, একপক্ষ সিরাম ইনস্টিটিউট এবং একপক্ষ বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে হওয়া চুক্তিতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীও।
ত্রিপক্ষীয় এই চুক্তিকে জিটুজি কেন বলা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয় সচিবের কাছে।
স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘জিটুজি যে বলতে যেটা বোঝায় আক্ষরিক অর্থে সেটা আমরা করিনি। বাট যাদের উপস্থিতিতে করেছি এবং সরকার যে এর সঙ্গে শতভাগ কনসার্ন আছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এটাকে আমি মেন ফোকাস করে বলছি পরোক্ষ জিটুজি।’
‘ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার সাহেব নিজে আমাকে বলেছেন। তার একটা ম্যাসেজ আছে এখানে (নিজের হাতের সেলফোনটিকে ইঙ্গিত করে)। ব্যস পরিষ্কার।’
‘আজকে একটু আগে (সোমবার দুপুরে) যেভাবে ইন্ডিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনার আমাকে বলেছেন, আমি তাতে আশ্বস্ত হতেই পারি। উনি তো ফোনে বলেছেন কথাটা। সেল ফোনে। ইজিলি আমরা উনার ভয়েসটাও নিতে পারি। তিনি বলেছেন এটা নিয়ে ওরিড (চিন্তিত) হবার কোনো কারণ নেই।’
চুক্তি অনুযায়ী প্রথমে আসবে ৫০ লাখ টিকা, যার জন্য ৬০০ কোটি টাকা বেক্সিমকো সিরামকে পরিশোধ করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
যেদিন টাকা দেয়া হবে, সেদিনই ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত আসে বজ্রাঘাত হয়ে। নয়াদিল্লি সিরামকে জানায়, টিকা বিদেশে রপ্তানি করা যাবে না।
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহম্মদ খুরশীদ আলমের সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তিনিও বলেছেন একই ধরনের কথা।
খুরশীদ বলেন, ‘ভারত যে শর্ত আরোপ করেছে এটা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক রপ্তানির বিষয়ে। এটা আমাদের টিকা আনতে বাধা হবে না।’
যা বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ের জরুরি বৈঠকের পর ব্রিফ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনও। তিনি বলেন, টিকা যথা সময়ে বাংলাদেশে আসবে।
তিনি বলেন, ‘আমরাও এ বিষয়টি নিয়ে সকাল থেকে কাজ করছি। জানতে পেরেছি। পুরোপুরি খবর আমরা এখনও অবহিত নই। ইতিমধ্যে বেক্সিমকো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে আমাদের মিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের মিশন ভারতের ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গেও আলোচনা করেছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘ওনারা আশ্বস্ত করেছেন, আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তিটি ব্যাহত হবে না।’
ভারত সব দেশের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশ্বস্ত যে সমস্যা হবে না, আশা করি সমাধান হয়ে যাবে। আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
৫ নভেম্বরের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটিকে আন্তর্জাতিক চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তিকে অনার করার একটা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সেটার ওপরও আস্থা রাখি।’
ভারত কী বলেছে, এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তারা কেউ নেগেটিভ কথা বলেনি। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পাব বলে তারা আশ্বস্ত করেছে।’
আপনি তো প্রত্যাশা করে বলছেন, কিন্তু তারা যদি টিকা না দেয় তাহলে কী করবেন- এমন প্রশ্ন মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখনও আশাবাদী।’
টিকা তাহলে কবে আসবে- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চুক্তি হয়েছিল, তারা অনুমোদন শেষে ডব্লিউএইচওর কাছে অনুমোদন পেতে আবেদন করবে। অনুমোদনের পর তারা আমাদের জানাবেন কবে নাগাদ তারা টিকা দেবে।
‘আমরা আশ্বস্ত থাকতে পারি, টিকা পেতে আমাদের কোনো ঝামেলা হবে না।’
টিকা নিয়ে বিকল্প ভাবনা
বিকল্প টিকার সন্ধানে ভারতের সিরাম ছাড়াও অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সরকার আলোচনা করছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সেই বিষয়গুলো তো হাতে আছেই।’
কাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘যেমন- চাইনিজ ভ্যাকসিন, রাশিয়ান ভ্যাকসিন, এগুলো আমাদের হাতে আছে। এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এখনও তাদের ট্রায়াল শেষ হয়নি। তাদের ট্রায়াল শেষ হলে আমরা এগ্রিমেন্টে যাব।’
চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।