ডেস্ক নিউজ
অধিকার পেয়েও তা ভোগ করতে না পারার বহুদিনের আক্ষেপ মিটতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের। ‘নতুন’ নামে ডাকা হলেও ডিএনসিসির এসব ওয়ার্ডের বয়স ৪ পেরিয়ে ৫ বছরে পড়েছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবার মেগা প্রকল্পের আওতায় এসব ওয়ার্ডে উন্নয়ন কাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যেই উন্নয়ন কাজে চার হাজার ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। চলতি মাসেই প্রকল্পের কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এর মাধ্যমেই কাগুজে মর্যাদায় সেবা পাবেন ২০ লাখ বাসিন্দা।
নতুন ওয়ার্ডের উন্নয়নের লক্ষ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। অ্যাকশন মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধাপে ধাপে সড়ক, নর্দমা, ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ করবে। প্রথম ধাপে ৪ হাজার ২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার এবং পরবর্তী কয়েক ধাপে আরো অন্তত ২২ হাজার কোটিসহ মোট ২৬ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করা হবে।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন ওয়ার্ডের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। আমরা নতুন এলাকাগুলোকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে এসব ওয়ার্ডগুলোর চেহারাই বদলে যাবে। তিনি বলেন, ওয়ার্ডগুলোর বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও উন্নয়নে প্রয়োজন হবে অন্তত সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যেই এলাকার উন্নয়নে ৪ হাজার ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে ওই এলাকার বাকি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
মেয়র বলেন, নতুন এই ১৮টি ওয়ার্ডের আয়তন ১১২ বর্গকিলোমিটার। আর পুরাতন ৩৬টি ওয়ার্ডের আয়তন ৮৪ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু খাস জমি পাওয়া যাবে। বাকি কার্যক্রম পরিচালনা করতে অনেক জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন চিন্তা থেকে আমরা ‘ভূমি ব্যাংক’ করব। শিগগিরই ডিএনসিসির নতুন এলাকার পরিকল্পনা গেজেটভুক্ত করা হবে।
ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবেশবান্ধব নগরায়ণের জন্য ১৮টি ওয়ার্ডে ৪০ একর খাস জমি হস্তান্তর ও ৪৬২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এ অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তত ৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় সবার উপযোগিতার কথা বিবেচনা করে ওয়ার্ড কমপ্লেক্স অফিস হবে ওয়ার্ডের নাগরিকদের মিলনস্থল। টেকসই উন্নয়নে ল্যান্ড ব্যাংক ও চার লেনের সড়ক হবে। এছাড়াও তারের জঞ্জাল সরাতে প্রথমবারের মতো তৈরি হবে ‘ইউটিলিটি ডাক্ট’।
ওয়ার্ডগুলোতে ১৮২ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করা হবে। এর মধ্যে ১০টি চার লেনের ৩৩ কিলোমিটার এবং দুই লেনের ৪১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। আর সব সেবা সংযোগকে এক জায়গায় আনতে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার ইউটিলিটি ডাক্ট এবং ৫৯ কিলোমিটার ওয়ার্কওয়ে ও সাইকেল লেন নির্মাণ করা হবে। ২৩৪ কিলোমিটার ড্রেন, ২৯ কিলোমিটার খাল এবং ১২ হাজার ২১৮টি এলইডি বাতি স্থাপন করা হবে। ডিএনসিসির আওতাভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়নের সেবা নিশ্চিত করতে ৫ আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছে
সংস্থাটি। এ কারণেই ঝামেলা এড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। অনেক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাত্র ৬ থেকে ৮ ফুট প্রস্থের সড়ক রয়েছে। বেশির ভাগ স্থানে বহুতল ভবন হয়ে গেছে। অনেক রাস্তা আঁকাবাঁকা। খাল দখলসহ অবৈধ স্থাপনাও তৈরি হচ্ছে খাস জমিতে। কাজ শুরু হলে সেখানে ভেঙে ফিট রাস্তা করতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিক্ষোভ হবে, মামলাও হবে।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, নতুন ওয়ার্ডের কাজ দ্রুত শুরু করতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলতি জানুয়ারি মাসেই সময় চেয়েছি। তিনি সময় দিলে উদ্বোধন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে নতুন ওয়ার্ডগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করবে সেনাবাহিনী।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে চ্যালেঞ্জের শেষ নেই। এসব এলাকার রাস্তাগুলো অনেক সরু। খালগুলো বেদখল হয়ে গেছে। সরকারি খাস জমির মালিকানার রেকর্ড ব্যক্তিনামেও উঠে গেছে। এজন্য অনেক আইনি ঝামেলাও মোকাবিলা করতে হতে পারে। তবে যতই চ্যালেঞ্জ আসুক আমরা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবই। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যেসব এলাকা অধিগ্রহণ করতে হবে সেজন্য জেলা প্রশাসককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবেন।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আদর্শ ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রশস্ত রাস্তা, ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা কেন্দ্র, শরীর চর্চা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার, কমিউনিটি সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাদুঘর ও নাট্যমঞ্চ, খেলার মাঠ, পার্ক, পশু জবাইখানা, গণশৌচাগার, বাস টার্মিনাল থাকা আবশ্যক। কিন্তু এসব নতুন ওয়ার্ডে এর জন্য পর্যাপ্ত সরকারি জায়গা থাকলেও তা বেদখল হয়ে গেছে। বেশির ভাগ স্থানে বহুতল ভবন উঠে গেছে। আবার অনেক সরকারি জায়গা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। এসব অধিগ্রহণ করে প্রকল্পের কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়াও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে হবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে।
ডিএনসিসির স¤প্রসারিত এলাকার অ্যাকশন এরিয়া প্ল্যানের পরামর্শক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, বিদ্যমান সমস্যাগ্রস্ত ঢাকার চেয়ে ভিন্নভাবে ওই এলাকাকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে জলাঞ্চল, খাল, সবুজ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে ভেঙে নতুন কিছু গড়তে গেলে নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে; সেটা মোকাবিলার প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।
২০১৬ সালের ২৮ জুন নাগরিক সেবা বাড়াতে হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা, বেরাইদ, ডুমনি, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে ১১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নতুন ১৮টি ওয়ার্ড হিসেবে করপোরেশনে যুক্ত হয়। ডিএনসিসিতে বিদ্যমান পাঁচটি অঞ্চলের বাইরে নতুন অন্তর্ভুক্ত ওয়ার্ডগুলো নিয়ে আরো পাঁচটি অঞ্চল তৈরি করা হবে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই ওয়ার্ডগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে তেমন কোনো কাজ করেনি সংস্থাটি। অধিকাংশ ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট কাঁচা, নেই সড়কবাতি ও ফুটপাত। খালগুলো ময়লার ভাগাড়। খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। এছাড়াও নগরায়ণের আগে আয়তন ও জনসংখ্যার বিবেচনায় কতটুকু উন্মুক্ত স্থান, জলাধার, সবুজ এলাকা থাকা দরকার তা নির্ধারণ করা হলেও সেই মোতাবেক কাজ হয়নি।
ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, প্রকল্পের আওতায় নতুন ওয়ার্ডে ১৮২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে। এর মধ্যে প্রধান সড়কগুলো চার লেনের ৩৩ কিলোমিটার করা হবে। দুই লেনের সড়ক হবে ৪০ কিলোমিটার। বিদুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবলসহ অন্যান্য তার মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য ৭৪৩ কোটি ৬৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে ৯৭ কিলোমিটার ইউটিলিটি ডাক্ট (টানেল)।
এছাড়া, ২৩৩ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে। এতে ব্যয় হবে এক হাজার ৫১ কোটি ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ওয়ার্ডগুলোতে ১৩টি খাল রয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ২৮ দশমিক ৫১ কিলোমিটার। এই খালগুলোর উভয় পাশে ৫৮ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার সাইকেল লেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২ কোটি ৫৬ লাখ ছয় হাজার টাকা। এছাড়া ১২ হাজার ২৬৭টি এলইডি বাতি স্থাপন করা হবে। এতে ব্যয় হবে ১২০ কোটি ২৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
ডিএনসিসি জানিয়েছে, মাস্টারপ্ল্যানে রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), ড্রাফট স্ট্রকচার প্ল্যান (২০১৬-৩৫), ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ ও ওয়াটার মাস্টারপ্ল্যান, ঢাকা যানবাহন কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাগুলো (আরএসটিপি) পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে যেন কোনো কিছু সাংঘর্ষিক না হয় সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।