ডেস্ক নিউজ
রাজধানী ঢাকা থেকে দক্ষিণের সমুদ্রবন্দর পায়রা (কুয়াকাটা) পর্যন্ত ২৬৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে রেলশিল্পে উন্নত ইউরোপের স্পেন। দেশটির একজন মন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যানে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে এ বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়েছেন। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সরকারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরে স্পেনের আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। গত ৭ ডিসেম্বর দূতাবাস থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে পাঠানো হয়। সূত্র জানায়, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের নেতৃত্বে সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সম্প্রতি স্পেন সফর করে। মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ‘রেল লাইভ-২০২১ সম্মেলন ও প্রদর্শনী’তে অংশ নিতে যাওয়া এই প্রতিনিধি দলটি গত ৩০ নভেম্বর স্প্যানিশ গণপরিবহন মন্ত্রী মিজ রেকুয়েল সানচেজ জিমেনেজের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে। এ ছাড়াও বিশ্বের দ্রুতগামী ট্রেন প্রস্তুতকারক বিশ্বখ্যাত কোম্পানি মাদ্রিদের টালগো ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে প্রতিনিধি দলটি। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশের রেলওয়ে অবকাঠামো খাতে স্পেনের আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক কথা বলবেন জানিয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-পায়রা রেললাইন ছাড়াও রেলের রি-রোলিং প্রকল্প নিয়ে স্পেন ছাড়াও ইউরোপের আরেকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নতুন বছরে নিজেই ঘোষণা দেবেন। এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা-পায়রা রেললাইন ছাড়াও দেশের রেললাইনগুলোর আপগ্রেডেশন এবং সারা দেশে রেললাইন সম্প্রসারণে রেলের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, তার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়েছে স্পেনের বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলোর কাছে। বাংলাদেশের রেল নিয়ে মহাপরিকল্পনা তুলে ধরার পর স্পেনের অন্তত সাতটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়ে সফরকারী দলের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক করে। তারা বাংলাদেশে ডিজেল ও বৈদ্যুতিক রেলপথ নির্মাণ, দ্রুতগামী প্যাসেঞ্জার কোচ তৈরিসহ রেলের বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়নে নিজেদের সম্পৃক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করে। এমন কি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে রেল অবকাঠামো উন্নয়নে স্প্যানিশ সরকারের ইনভেস্টমেন্ট স্কিম থেকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়েও আশ্বাস দেন। আগ্রহী স্প্যানিশ কোম্পানিগুলোর মধ্যে টালগো, টিপসা, ফ্লিক্সট্রেইন, লা ফারগা, স্টেডলার, সেনার উল্লেখযোগ্য।
দক্ষিণাঞ্চলকে বদলে দেবে ঢাকা টু পায়রা রেললাইন : গত বছরের ২৯ নভেম্বর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত রেললাইন চালুর ঘোষণা দেন। সারা দেশে রেলযোগাযোগকে শক্তিশালী করতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আরও প্ল্যান আছে যে, একেবারে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত আমরা রেললাইন নিয়ে যাব। তারও সমীক্ষা আমরা শুরু করব এবং সেই উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।’
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই রেল মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করার পর অর্থায়নকারী সংস্থা খোঁজার উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে প্রকল্পটির জন্য অর্থায়নকারী সংস্থা খোঁজার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে চিঠি দিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়।
সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত। সমীক্ষা ও নকশা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত এই রেললাইনটি রাজধানীসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতটি জেলা স্পর্শ করবে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত যে রেললাইন রয়েছে, সেখান থেকেই শুরু হবে পায়রা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ এ প্রকল্পটি। এই রেলপথ হবে ব্রডগেজ। এতে ভবিষ্যতে যেন বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো যায়, সে ব্যবস্থাও রাখা হবে। এই পথে সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় ট্রেন চলতে পারবে এমন পরিকল্পনায় কাজ করছে রেল কর্তৃপক্ষ।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যাবে ট্রেন। পায়রা বন্দর ঘিরে রেলওয়ে অর্থনৈতিক জোন করতে চায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে এ প্রকল্পের অধীনে বরিশালেও রেলওয়ে মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ করা হবে। এই দুই জায়গাসহ এই পথে মোট ১৯টি বড় রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার নিচু জমিতে হবে উড়াল (ভায়াডাক্ট) রেলপথ। কালীগঙ্গা, আমতলী, আন্ধার মানিক, কীর্তনখোলা, পায়রাসহ মোট ১০টি নদীতে নির্মাণ করা হবে ৪৬টি বড় রেল সেতু। থাকবে ৪৪০টি বক্স কালভার্ট।
রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। তৈরি হয়েছে রেলপথ নির্মাণের নকশা। এখন ফরিদপুরকে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। ভাঙ্গায় তৈরি হবে রেল জংশন। ভাঙ্গা-কুয়াকাটা প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যবস্থা হলে শুরু হবে দরপত্র আহ্বান, যাচাই-বাছাই, জমি অধিগ্রহণসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এই রেলপথ নির্মাণের জন্য সাড়ে পাঁচ বছর সময় ধরা হয়েছে। ২০৩০ সালে ট্রেনে চড়েই কুয়াকাটা যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে রেলওয়ে।