ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চ্যালেঞ্জ থাকলেও পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে দৃঢ় ও পরীক্ষিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে দুদেশ আগেও সমস্যা নিরসনে যথেষ্ট সফল হয়েছে। ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যকার সংলাপে সব মতভেদ ঘুচে যাবে। ভারত সফরের একদিন আগে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালকে (এএনআই) দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আজ ভারত সফর যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। ৫-৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ দিনের এ রাষ্ট্রীয় সফরে দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হবে। তার এ সফরকে সামনে রেখে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এএনআইয়ের স্মিতা প্রকাশ। রোববার সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এর আগেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দুদেশ প্রমাণ করেছে যে-আলোচনার মাধ্যমে মতানৈক্য ও মতভেদ নিরসনে তারা যথেষ্ট সফল। দুটি ইস্যুতে তিনি ভারত সরকারের বিশেষ প্রশংসা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে পাশের দেশ পোল্যান্ডে আশ্রয় নেন বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের নয়াদিল্লিতে ফিরিয়ে আনার সময় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও সঙ্গে আনার জন্য তিনি মোদি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আটকেপড়া ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের আনার মধ্যদিয়ে স্পষ্টতই নয়াদিল্লি অকৃত্রিম বন্ধু দেশের মতো হাত বাড়িয়েছে। এজন্য মোদি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ভারত সরকারের মৈত্রী টিকাদান কর্মসূচিরও প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সমঝোতা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে ভারত সরকারের করোনাপ্রতিরোধী টিকা সরবরাহ কার্যক্রম এক বিশেষ প্রশংসিত উদ্যোগ। এমন যথার্থ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির প্রজ্ঞা প্রমাণিত হয়। ভারতকে পরীক্ষিত বন্ধু উল্লেখ করে তিনি বলেন, নয়াদিল্লি প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রথম ১৯৭১ সালে এবং বিভিন্ন সময় দেশটি এগিয়ে আসে। তিনি আরও বলেন, দুদেশের জনগণের স্বার্থেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করা উচিত।
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশে যখনই কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নিজ দেশের হিন্দুদের ও বিশ্ব নেতাদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, তার সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার জোরালো সমর্থক। এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়-এমন যে কোনো ধরনের ঘটনা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, উগ্র চরমপন্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বহু দেশে বিদ্যমান। ভারতও এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। চরমপন্থা বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হিসাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি সমাজে বাজে প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, আমি তাদের (সংখ্যালঘু) বলে আসছি, আপনারা এ দেশেরই জনগণ। আপনাদের উচিত এ দেশকে নিজের মনে করা। কিন্তু কোনো কোনো সময় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, শুধু বাংলাদেশেই এমন কিছু ঘটে তা নয়; ভারতেও সংখ্যালঘুরা মাঝে-মধ্যে ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতের অবদানের কথা সব সময় স্মরণ করি। এমনকি ১৯৭৫ সালে যখন আমার পরিবারের সব সদস্যকে হারালাম তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এছাড়া আমরা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং আমি সব সময় আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেই।
সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গটি আসে। তিস্তার পানি বণ্টনসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, এটি এখনও ঝুলে আছে। ভারত থেকে আমাদের এখানে পানি আসে, তাই তাদের আরও উদারতা দেখাতে হবে। এতে উভয় দেশই লাভবান হবে। পানির অভাবে কখনও কখনও আমাদের জনগণ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে তিস্তায় পানি না পেয়ে আমরা ফসল রোপণ করতে পারি না। আরও নানা সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে বিষয়টির একটি সমাধান হওয়া উচিত। আমরা দেখেছি, এ সংকটের সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ রয়েছে। তবে সমস্যাটি ভারতেই রয়ে গেছে। আশা করি এর সমাধান হবে এবং সেটি হওয়া উচিত।
শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য ‘বড় বোঝা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে তার সরকার। এ সমস্যা সমাধানে প্রতিবেশী ভারত মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি আরও বলেন, ভারত বড় দেশ, সেখানে থাকার জায়গা অনেক। কিন্তু দেশটিতে খুব বেশি রোহিঙ্গা নেই। আর আমাদের দেশে তাদের সংখ্যা ১১ লাখ। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। তাদেরও কিছু করণীয় আছে, যাতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে পারে। তিনি বলেন, আমরা শুধু মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। সব ধরনের সহায়তা দিয়েছি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে করোনা মহামারির সময়ে টিকার আওতায় এনেছি। কিন্তু তারা আর কতদিন এখানে থাকবে? তারা এখন আমাদের পরিবেশকে বিপজ্জনক করে তুলছে। রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ মাদক পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, নারী পাচারসহ নানা ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে। তারা যত দ্রুত নিজ দেশে ফিরবে, আমাদের ও মিয়ানমারের জন্য ততই মঙ্গল হবে। আমাদের দিক থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাদের প্রত্যাবাসনে আসিয়ান, ইউএনওসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এক্ষেত্রে ভারত বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জানান, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কিনা, সে ব্যাপারটি তার নিজের (জয়) ও দেশের মানুষের চাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। জয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। সুতরাং রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার ব্যাপারটা তার ওপরই নির্ভর করছে। জয় দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তার পরামর্শ অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্যাটেলাইট, সাবমেরিন কেব?ল কিংবা কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মতো এত সব ডিজিটাল ব্যবস্থা তার পরামর্শেই নেওয়া হয়েছে। ও আমাকে সহযোগিতা করছে। তবে ও কখনোই দল কিংবা মন্ত্রণালয়ে কোনো পদ পাওয়ার কথা ভাবেনি। এক সমাবেশে জয়কে দলীয় একটি পদে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য কর্মীদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উঠেছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দলীয় সম্মেলনে পর্যন্ত তার জন্য জোরালো দাবি উঠেছিল। তখন আমি ওকে বললাম, মাইক্রোফোনের কাছে যাও এবং বল তুমি কী চাও। ও তাই করল। ও বলল, ‘আমি এ মুহূর্তে দলে কোনো অবস্থান চাই না। বরং যারা এখানে কাজ করছেন, তাদের এ পদ পাওয়া উচিত। আমি কেন একটা পদ দখল করে রাখব? আমি আমার মায়ের সঙ্গে আছি, তাকে সহযোগিতা করছি ও দেশের জন্য কাজ করছি। আমি তা করে যাব।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিষয়টি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়।
ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রাখাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত পরিষ্কার-‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’