ডেস্ক নিউজ
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে বলা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ উন্নয়নশীল দেশ হতে চলেছে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ আজ একটি আলোকিত নাম। ভয়াবহ করোনা মহামারিতে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি যেখানে নাজুক, সেখানে বাংলাদেশ করোনার ধাক্কা উপেক্ষা করে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমদানি-রফতানি, রেমিট্যান্সে অতীতের রেকর্ড ভাঙছে। অর্থনীতির সব মানদণ্ডে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বিজয়ের ৫০ বছরে এসে এ যেন এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ বছরের পথচলা সামান্য নয়। সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাইলফলকে পৌঁছে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি, প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জের মূল্যায়ন জরুরি। অনেকেরই ধারণা ছিল, বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে অর্থনৈতিক দিক থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছি। আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি, কৃষি সম্প্রসারণ, শিল্পের উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি ও পোশাক শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতিসহ রফতানি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী এক দশক আমাদের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে অর্থনীতির কাঠামো ছিল নাজুক অবস্থায়। ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৭৫ ভাগ (১৯৭২-৭৩)। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.০৮ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে সার্বিক বিনিয়োগের ৩৭ শতাংশের মধ্যে ব্যক্তি খাতের অবদান ছিল ৮০ শতাংশ। তবে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী বলা যায়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমাদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.০৮ শতাংশ। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ৫.০৯ শতাংশ। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সময়কালে বেড়ে হয়েছে ৬.০২ শতাংশ। ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭.০৪ শতাংশে। এশিয়ার ১২টি দেশের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায়, আমাদের গড় প্রবৃদ্ধির হার ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছিল। অর্থাৎ আমাদের প্রবৃদ্ধির হার মোটামুটি সন্তোষজনক। স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্জনের মধ্যে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ বর্তমানে অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। ১৯৭৪ সাল থেকে যেখানে আমাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র ৪২.৫ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২১ সালের রিজার্ভের পরিমাণ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যে জনসংখ্যা ছিল ৫০ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তখন আমাদের কৃষি ও খাদ্যশস্য উৎপাদন সন্তোষজনক ছিল না। বর্তমানে ব্যাপক জনসংখ্যার মধ্যেও আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। চলমান করোনা মহামারির সময় অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম অবদান রেখে চলেছে আমাদের কৃষিজ উৎপাদন। ১৯৭২ সালে ধান উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধান উৎপাদন হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন।
আমাদের ব্যাপক জনসংখ্যার জন্য সারাবছর আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৭০ লাখ টন। সেখানে ২০১৯ সালে উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টন। বিশ্বে আলু উৎপাদনে আমরা ষষ্ঠ। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ইলিশ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম। বিশ্বের উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশ উৎপাদিত হচ্ছে, যার পরিমাণ ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন। সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বছরে সবজি উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। হাঁস-মুরগি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরু, ছাগল পালন ও ফল উৎপাদনেও প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী।
এফএও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাগলের গোশত ও দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ ক্রমাগত ভালো করছে। বিশেষ করে ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। ছাগলের সংখ্যা ও গোশত উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এ ছাড়া আম ও পেয়ারা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে আছে। বছরে আম উৎপাদন হয় ২৪ লাখ টন। পেয়ারা উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৪৭ হাজার টন। আম ও পেয়ারা উৎপাদনে প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রথম অবস্থানে আছে। ৫০ বছরের ব্যবধানে মুদ্রাস্ফীতি ৫.৫ ভাগ, ৮৬ টাকা ডলার প্রতি মূল্য এবং রফতানি আয় যেমন বেড়েছে, তেমনই আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ হাজার ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করেছে।
বিজয়ের ৫০ বছরে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে পরবর্তী ধাপে উত্তরণের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হবে।