ডেস্ক নিউজ
নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আর মাত্র নয় দিন বাকি। উদ্বোধনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে মানুষের উচ্ছ্বাস ততই বাড়ছে। তিনটি বিশ্বরেকর্ড গড়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায় কোটি বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ৪০ তলার সমান পাইলিং, ১০ হাজার টনের বেশি ধারণ ক্ষমতার বেয়ারিং আর নদী শাসনে এ মেগা স্ট্রাকচার গড়েছে বিশ্বরেকর্ড। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হলে ১২০ বছরেও কিছু হবে না এ সেতুর। পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্টরা এমনটাই বলছেন। সূত্রমতে, খরস্রোতার দিক থেকে বিশ্বে আমাজনের পরেই পদ্মা নদীর অবস্থান। পানি প্রবাহের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে। তেমন একটি নদীকে বশে এনে নিজের টাকায় এমন ইমারত। বহুরূপী একটি নদীর তলদেশে পাইলিং করতেও কম বিপাকে পড়তে হয়নি। একেকটি পিলারের নিচের মাটি ছিল একেক রকম। শেষ পর্যন্ত ১২০ থেকে ১২৮ মিটার পাইলিং করতে হয়েছে। পিলারের ওপর ১০ হাজার ৫০০ টন সহনশীল বেয়ারিং বসানো হয়েছে, যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। আবার রেকর্ড পরিমাণ নদী শাসন করেই বাগে আনতে হয়েছে পদ্মাকে। জানা গেছে, সানফ্রানসিস্কোতে অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে যেটা আছে, সেটা ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টন সহনশীল। পদ্মা সেতুতে ১০ হাজার ৫০০ টন সহনশীল বেয়ারিং বসানো হয়েছে। আরেকটা বিশ্বরেকর্ড হলো, এখানে দুই দিকে ১২ কিলোমিটার নদী শাসনের যে কাজটি আছে, সেটি সিঙ্গেল কন্ট্রাক্টে বিশ্বে সর্বোচ্চ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে এমন কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে যা বিশ্বের অন্য কোনো সেতুতে ব্যবহার করা হয়নি। বিভিন্ন দিক দিয়ে পদ্মা সেতু বিশ্বে রেকর্ড করেছে। ভূমিকম্প বেয়ারিং টেস্টিং করার জন্য চীন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে এবং আসতে শুধু প্লেন ভাড়াই খরচ হয়েছে ২ কোটি টাকা। এ সেতু নির্মাণে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে। সেতুর পাইল ১২২ মিটার লম্বা ও এর ডায়ামিটারের আয়তন তিন মিটার। বিশ্বের কোনো সেতুতে এ ধরনের পাইল ব্যবহার করা হয়নি।’ সেতু সংশ্লিষ্টরা জানান, মূল পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সংযোগ সেতু ও সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। প্রকল্পে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও রেললাইনসহ দ্বিতল সেতুর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন কাজে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, পুনর্বাসনে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, ২৭০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণে ১ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও অন্যান্য ব্যয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুতে ২৯৪টি পাইল রয়েছে। এসব পাইলের গড় গভীরতা ১২২ মিটার; যা ৪০ তলা ভবনের সমান। নদীর তলদেশের মাটির অবস্থা খারাপ হওয়ায় ২২টি পিলারেরর ৭১টি পাইলে স্কিন গ্রাউট করতে হয়েছে।
প্রকৌশলীরা জানান, মাটির নিচ থেকে পানির কিছুটা ওপর স্তর পর্যন্ত পাইলের অবস্থান। কয়েকটি পাইলের ওপর একটি করে পাইল ক্যাপ বসানো হয়েছে। ওই ক্যাপের ওপর সেতুর পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুতে মোট পিলার রয়েছে ৪২টি। পিলারের ওপর এমন উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে যে, ১৮ দশমিক ৩ মিটার উচ্চতার জাহাজ অনায়াসে সেতুর নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘সেতু রক্ষণাবেক্ষণের একটি গাইডলাইন করে দেব। সেই অনুসারে পরিচালনা করলে ১০০ বছরের বেশি টিকে থাকবে এই স্বপ্নের ইমারত। কোন কাজ কখন করতে হবে, কোন কাজ প্রতিদিন করতে হবে, কোন কাজ সপ্তাহে একবার করতে হবে, কোন কাজ মাসে একবার করতে হবে, কোন কাজ বছরে একবার করতে হবে, কোন কাজ পাঁচ বছর পরপর করতে হবে- এই গাইডলাইন যদি তারা ঠিকমতো প্রতিপালন করেন, তবে এই সেতুর আয়ু শত বছরের বেশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।’ জানা গেছে, সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উৎসবমুখর ও স্মরণীয় করে রাখতে প্রশাসনের পাশাপাশি এরই মধ্যে দক্ষিণের ২১ জেলার সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সেতুটির উদ্বোধন ঘিরে দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে দেখা যায় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। কোনো কারণে এই উৎসবের আনন্দ যেন ম্লান হয়ে না যায়, সেজন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের এরই মধ্যে সাবধানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে পরীক্ষামূলকভাবে গত সোমবার ২০৭টি লাইট জ্বালানো হয়েছে। এর আগে জেনারেটরের মাধ্যমে সেতুর সড়কবাতি জ্বালানো হয়। তবে এবারই জ্বালানো হয়েছে সরাসরি বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে। এ নিয়ে গত সাত দিনে পর্যায়ক্রমে ৪১৫টি বাতি জ্বালানোর মাধ্যমে স্ট্রিট লাইটের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শেষ হয়েছে।
পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসছে, সম্ভাবনা আর প্রত্যাশার নতুন দিকও উন্মোচিত হচ্ছে। কুয়াশা, বড় কোনো ঝড় কিংবা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে পদ্মা সেতুতে তাৎক্ষণিক মিলবে পূর্বাভাস। এ জন্য মাওয়া প্রান্তে থাকছে আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র। দুর্যোগের দুই ঘণ্টা আগেই জানা যাবে তথ্য। প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানালেন, সেতুর মাওয়া প্রান্তেই থাকছে আবহাওয়া পূর্বাভাসের এই সাব স্টেশন। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেশ আগেই মিলবে সতর্কবার্তা। সে অনুসারে প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেতুতে যান চলাচল। তিনি বলেন, কুয়াশার কারণে যদি কিছুই দেখা না যায়, তখন কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল বন্ধ রাখা হবে।
পুরো পদ্মা সেতুতে আলোর ঝিলিক : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে গত সন্ধ্যায় একসঙ্গে জ্বলে ওঠে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টের বাতি। সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে মূল সেতুতে এ বাতি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে দেখা দেয় আলোর ঝিলিক। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আগের দিন সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মাওয়া প্রান্তের ল্যাম্পপোস্টে ২০৭টি বাতি জ্বালানো হয়েছিল। পুরো সেতুতে সবকটি অর্থাৎ একসঙ্গে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বালানো হলো এই প্রথম। এর আগে ৪ জুন বিকালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। ওই দিন সেতুর ১৪ থেকে ১৯ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি ২৪টি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বালানো হয়েছিল। এরপর ১১ জুন পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে সেতুর সবকটি বাতি জ্বালানো হয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে ৪১৫টি। দুই পাশের সংযোগ সড়কে রয়েছে আরও ২০০ বাতি। গত বছরের ২৫ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল এসব ল্যাম্পপোস্ট বসানো ও এর মধ্যে বাতি লাগানোর কাজ শেষ হয়। এরপর পুরো সেতুতে কেবল টানা হয়।
২৪ মে প্রথমে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সেতুকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা প্রান্তে ৪২ নম্বর পিয়ারে এ বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের কাজ শেষ হয়। এরপর মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিও সেতুতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়। ৩০ মে প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজ শেষ করে মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। উল্লেখ্য, ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোটা জাতির স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন।