ডেস্ক নিউজ
যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুতে বসেছে প্রথম স্প্যান। এর মাধ্যমে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর একটি মাইলফলকে পৌঁছাল সেতুটি। চলতি মাসের শেষের দিকে আরো একটি স্প্যান বসানো হবে। আগামী মাসে পাশাপাশি তিনটি স্প্যান দৃশ্যমান হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে দুই অঞ্চলে বিভক্ত। এই সেতু চালু হলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের বর্তমান অবস্থা বদলে যাবে। মূলত যমুনা নদীই রেলওয়েকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বাংশ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম পর্যন্ত এলাকা পূর্বাঞ্চল। আর সেতুর পশ্চিমাংশ থেকে রাজশাহী, খুলনাসহ ওই অংশকে বলা হয় পশ্চিমাঞ্চল।
এই পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনের ধরনও আলাদা।
পূর্বাঞ্চলের রেললাইনে প্রায় সবই মিটার গেজ ট্রেন চলাচল করে। এই ট্রেনগুলো প্রস্থে তুলনামূলকভাবে ছোট। তাই রেললাইনগুলো সরু থাকে। আর পশ্চিমাঞ্চলের রেললাইনে বেশির ভাগ ব্রডগেজ। রেললাইন তুলনামূলক বড়।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে এক লাইনের রেল ট্র্যাক আছে। এই লাইন দিয়ে খুব ধীরে ট্রেন চলতে পারে। পূর্ব স্টেশন থেকে একটি ট্রেন ছাড়লে পশ্চিম স্টেশনের ট্রেনকে অপক্ষোয় থাকতে হয়। এখন বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নামে একটি ডুয়াল গেজ রেল সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। এই সেতুতে ব্রড গেজ ও মিটার গেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলাচল করতে পারবে। রেললাইন থাকবে দুটি। ফলে সেতু পারাপারের জন্য ট্রেনকে অপেক্ষায় থাকতে হবে না।
রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি বলেছেন, দেশের প্রতিটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পর্যায়ক্রমে পুরো রেলব্যবস্থা ব্রড গেজ করা হচ্ছে। এতে আন্তর্দেশীয় ট্রেন চলাচলেও সুবিধা হবে।
সেতু চালু হলে কী হবে : প্রকল্পের সম্ভাব্য ধারণা ও রেলের নথি অনুযায়ী, এখন বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলছে। নতুন সেতু চালু হলে দিনে ৮৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু দিয়ে যেখানে ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করে, সেখানে নতুন রেল সেতুতে ব্রড গেজ ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটার গেজ ট্রেন ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। এতে বাঁচবে সময়।
তবে এই এক সেতুতেই সব সুফল মিলবে না, এর সঙ্গে আরো কিছু কাজ যুক্ত করতে হবে বলে মনে করছেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী। গত বৃহস্পতিবার তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে ডুয়াল গেজ এবং ডাবল লাইন রয়েছে। তবে ঈশ্বরদী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সিঙ্গল লাইন হওয়ায় আপাতত প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে না। এই পথ ডাবল লাইন করা গেলে বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল বদলে দেবে।
কাজ এগিয়েছে ৪৪ শতাংশ : প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৪৪ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৪.৬১ শতাংশ। এ পর্যন্ত একটি স্প্যান বসানো হলেও প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে ১০টি স্প্যান। আরো ২০টি স্প্যান বিভিন্ন ধাপে নির্মাণ পর্যায়ে রয়েছে। এই সেতুর স্প্যানগুলো ভিয়েতনামে তৈরি করা হচ্ছে।
প্রকল্পের অধীনে নদীশাসনের কাজ চলমান আছে। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৪৩১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেতুর দুই পাশের সংযোগ বাঁধের নির্মাণকাজও চলছে। তবে সেতুর দুই পাশে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশনের ভবন আধুনিক করা; এই দুই স্টেশনের সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনব্যবস্থার উন্নতি করা এবং রেলওয়ে সেতু নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। আশা করছি, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব। ’
পশ্চিমের কাজে ধীরগতি, বাড়তে পারে নির্মাণ সময় : সেতুর মোট ৫০টি খুঁটির মধ্যে আটটির কাজ শেষ। আরো ৩০টির কাজ প্রায় শেষের পথে। এই ৩৮টি খুঁটির মধ্যে সাতটির অবস্থান পশ্চিমাঞ্চলে, বাকি ৩১টি পূর্বাঞ্চলে। এতে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চলে কাজে ধীরগতি রয়েছে। দুই অঞ্চলের নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও দুটি। সেতুর ৫০টি খুঁটির মধ্যে ২৩টি পশ্চিমাঞ্চলে, বাকি ২৭টি পূর্বাঞ্চলে পড়েছে। গত ২৯ জুলাই সেতুর ৪৭-৪৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয়। ২০ আগস্ট বসে প্রথম স্প্যান।
এ বিষয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমাঞ্চলে কাজের গতি কিছুটা কম। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তারা কাজের গতি না বাড়ালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে না।
প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ১৬ মাস : ২০২৪ সালের মধ্যে এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। এরই মধ্যে ১৬ মাস সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ২০২৪ সালের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করতে চাই। সেই লক্ষ্যেই কাজ হচ্ছে। তবে নির্মাণকাজ শেষ করার পর ট্রেন চলাচল শুরু হলে কোনো ত্রুটি দেখা দেয় কি না, তার জন্য বাড়তি সময় রাখা হয়েছে। ’
একলাফে ব্যয় বাড়ল সাত হাজার কোটি টাকা : ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেল সেতুটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম সংশোধনীর পর সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন থাকবে ২৭.৬০ শতাংশ বা চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দেবে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা পুরো প্রকল্পের ৭২.৪০ শতাংশ।
প্রকল্পে যা থাকছে : সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৮০ কিলোমিটার। তবে দুই পাশে .০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সেতু), ৭.৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ সড়ক (সংযোগ বাঁধ) থাকবে। আর লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০.৭৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে।