ডেস্ক নিউজ
প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা
বিনিয়োগে আগ্রহী চীনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে পরিকল্পিত নগরী, পর্যটন কেন্দ্র আধুনিক সেচ ব্যবস্থায় স্থাপন করা হবে কৃষি খামার তিস্তাপাড়ের গ্রামগুলোতে বইছে আনন্দের বন্যা
জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট ॥ মুজিববর্ষে দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষকে তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। চীন এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ; যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদী পাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। রংপুর ও লালমনিরহাট টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো সুন্দর নগরী। দেড় শ’ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। গড়ে উঠবে আধুনিক সেচ সেবা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কৃষি খামার। নৌপথ চালু করা হবে। তিস্তা নদী পাড়ে নতুন নতুন পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পের এই অগ্রগতির সংবাদ নিশ্চিত করেছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন। এ খবরে তিস্তা পাড়ের গ্রামগুলোতে আনন্দের বন্যা বইছে।
তিস্তা দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে দুই কূল প্লাবিত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জনপদ। শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার। বাংলাদেশ তিস্তা সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করলে ভারত এই প্রকল্পের ৬৫ কিলোমিটার উজানে কালীগঞ্জের গজলডোবায় একটি সেচ প্রকল্প তৈরি করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এ কারণেই তিস্তা পাড়ে প্রতিবছর এমন বন্যা ও খরা দেখা দেয়। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক আলোচনা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। চীন বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যার পরিমাণ বাংলাদেশের অর্থে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তিস্তা নদী ঘিরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি চুক্তির খুব একটা প্রয়োজন হবে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নেবে। পাল্টে যাবে উত্তরের জনজীবন। এখানে থাকবে না কোন বেকার সমস্যা। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ এখানে কাজ করতে আসবে। তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখের দিন শেষ হয়ে যাবে। বন্ধ হবে তিস্তা পাড়ের মানুষের কান্না।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন ও পান্নি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামে এই প্রকল্প শেখ হাসিনার সরকার বাস্তবায়ন করতে হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক আট হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরও হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ এম আমিনুল হক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইয়োলো রিভার ইঞ্জিনিয়ারিং চায়না নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকৌশলগত ও আর্থিক সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন এই প্রকল্পে সহজশর্তে স্বল্পসুদে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দিতে আগ্রহী।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগে একটি চক্র এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। তাদের মতে, চীনের অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়, এটি বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বিশ্বের সকল দেশকে এখানে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়। চীন এগিয়ে এসেছে। ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে বৈরিতার কোন সুযোগ নেই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে চীন সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান। সেই সময় চীনের সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে বেশ কয়টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই সময় শেখ হাসিনা এক সময় চীনের অভিশাপখ্যাত হোয়াং হো নদী নিয়ন্ত্রণ করে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তিস্তাকে আশীর্বাদে রূপ দেয়া যায় কিনা তার প্রস্তাব দেন। চীন সরকার নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা শেষে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। চায়না পাওয়ার নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই সার্ভে ও ডিজাইন করে।
তিস্তা নদীর বর্তমান নাব্য হ্রাস পেয়েছে। তাই তিস্তা নদীর প্রশস্ততা কোথাও ৮ কিলোমিটার কোথাও আবার ১২ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে মরুভূমির মতো রূপ নেয়। এই পরিকল্পনায় তিস্তা নদীর গভীরতা বাড়াতে খনন কাজ করা হবে। নদীর গভীরতা আরও প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি করা হবে। সারাবছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এই সংরক্ষিত পানি দিয়ে নদী পাড়ের পুনরুদ্ধার হওয়া লাখ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ ব্যবস্থা করা যাবে। গড়ে উঠবে আধুনিক কৃষি খামার ব্যবস্থা। পুনর্বাসন করা হবে তিস্তা পাড়ের লাখ লাখ ভূমিহীন, নদীভাঙ্গা পরিবারকে। তিস্তা হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সম্পদ। তিস্তায় ফিরে আসবে জীববৈচিত্র্য। মরু প্রক্রিয়ার হাত হতে রক্ষা পাবে তিস্তা পাড়ের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌসুমি মঙ্গা স্থায়ীভাবে ঘুচাতে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কয়েক লাখ হেক্টর কৃষিজমি উদ্ধার করতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই বছর ধরে তিস্তা নদী সার্ভে, পরিকল্পনা, ডিজাইন ও অর্থ ব্যয়ের পরিমাণসহ সকল প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এখন শুধু বাস্তবায়নের পথে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীনসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও দেশ অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। এই পরিকল্পনা সরকার খুব কৌশলী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর আগে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কোন প্রচার ছিল না।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্যপীড়িত জেলা লালমনিরহাটকে কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে গড়ে তুলতে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার সরকার অর্থের যোগান করতে বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের সহায়তা চেয়েছে। বিশ্বের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তাব পাওয়া গেলেও চীনের প্রস্তাবটি অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য।
এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে লালমনিরহাট জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে দারিদ্র্য মুক্ত করতে কাকিনার মহিপুরে তিস্তা নদীতে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে লালমনিরহাট জেলা তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের আওতায় আসত। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর কাকিনায় সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়নি। এক সময়ের খর¯্রােতা তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলের আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে পরিণত হয়ে যায়। তিস্তা সেচ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করলে ভারত এই প্রকল্পের উজানে ৬৫ কিলোমিটার দূরের কালীগঞ্জের গজলডোবায় গজলডোবা সেচ প্রকল্প তৈরি করে। যার কারণে বর্ষা মৌসুমে ভারত গজলডোবা ব্যারাজ দিয়ে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা নদীর পানির তোড়ে জেলাবাসী দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ে। নদী ভাঙ্গনে নিস্ব হয় লাখ লাখ মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ভারত সরকার গজলডোবা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ব্যারাজের ৪৪টি গেটই বন্ধ রাখে ভারত। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা হয়ে ওঠে বিশাল মরুভূমির মতো। উভয় মৌসুমে তিস্তা পাড়ের মানুষ থাকে মহাবিপাকে। তিস্তায় পানি না থাকায় বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। শুরু হয়েছে মরু প্রক্রিয়া।
১৯৮৯ সালের পর থেকে তিস্তা নদী ঘিরে পেশাজীবী যেমন মৎস্যজীবী, খেয়াঘাটের নৌকার মাল্লা, কৃষিজীবীসহ নানা পেশার হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে কয়েক লাখ মানুষ পথে বসে যায়। লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বিত্তবান জোতদার কৃষক পরিবার রাতারাতি পথের ফকিরে পরিণত হয়। নেমে আসে দারিদ্র্য। তিস্তা পাড়ে গৃহহীন মানুষ ঝুঁপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে। দেখা দেয় মঙ্গা।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছরের ঐকান্তিক চেষ্টায় নানা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে তিস্তা পাড়ের মানুষকে নিয়ে আসেন। নদীর চরের বাড়িঘর বন্যামুক্ত করতে ভিটা উঁচু করে দেয়া হয়। বাড়িতে বাড়িতে খামার করতে সরকারী কর্মসূচী হাতে নেয়। গবাদিপশু পালনসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে চরের নারীদের সম্পৃক্ত করাসহ চরে শুষ্ক মৌসুমে নানা ফসল ফলাতে সরকারী ভর্তুকি দেয়া হয়। বিনামূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কিষান-কিষানিকে সরকারীভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রায় প্রতিটি চরে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। চরবাসীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৬ হাজার জনবসতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিক। চরে অভাবের সময় কর্মহীন মানুষের কাজ নিশ্চিত করতে বছরে দুবার ৪০দিন ৪০দিন করে কর্মসৃজন কর্মসূচী সরকারীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। এসব নানা উদ্যোগে এখন তিস্তা পাড়ের মানুষ মঙ্গা মুক্ত হয়েছে। এখন আর মৌসুমি মঙ্গা নেই। শেখ হাসিনার বদৌলতে মঙ্গা এখন অতীত। আর যাতে কোনদিন মঙ্গা ফিরে না আসে তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশে যে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিস্তা। এটি ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপত্তি হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিস্তা প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগে ভারত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। ১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন চুক্তি নেই। দীর্ঘদিন থেকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ আলোচনা করতে চাইলেও কোন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশ সফরে না আসায় তা সম্ভব হয়নি। পরে ২০১৫ সালে মমতা ঢাকায় এলেও তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। তবে তিনি সেই সময় বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিক দিক থেকে একে অপরের অকৃত্রিম বন্ধু। পশ্চিমবঙ্গ এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষতি হয়। তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রাণ। তিস্তা নদীর কোন ক্ষতি মানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি। তিস্তার কারণে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মানুষ তিস্তার পাড় ঘেঁষে বসতি গড়ে তুলেছে। তিস্তা মিঠাপানির একটি বিরাট উৎস।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখায় বর্তমান মোদি সরকার। কিন্তু ভারতের আইন অনুযায়ী, রাজ্যের অনুমোদন ছাড়া কেন্দ্র কোন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না। যার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে আর তিস্তা চুক্তি ভারতের করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার তিস্তা নদীর বিষয়টি নিয়ে ইস্যু ঝুলিয়ে রাখতে চান না। বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানি চুক্তির বিষয়টির বিকল্প হিসেবে তিস্তা নদীর পানির নাব্য বৃদ্ধি, ভাঙ্গন রোধ ও দুই পাড়ে গাইড বাঁধ নির্মাণ করার চিন্তা করছে। এই উন্নয়ন কর্মকা- উত্তরের জেলাগুলোকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের স্থায়ী সমৃদ্ধি আসবে।
তিস্তার মহাপরিকল্পনা বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ এম আমিনুল হক জানান, চীন নিজ খরচে সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। আমরা ইআরডিকে জানিয়েছি অর্থায়নের ব্যাপারে বিদেশী সহায়তার ব্যবস্থা করতে। চীন যদি ইআরডির সঙ্গে যোগাযোগ করে আগ্রহ প্রকাশ করে তা হলে এটি বাস্তবায়নের পথে এগোবে।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর ধরে তিস্তা পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাপরিকল্পনার নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নক্সা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করেছে। তারা সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রাথমিক ব্যয় ধরেছে। পৃথক প্রজেক্ট আকারে পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজ বাস্তবায়ন করবে। শীঘ্র টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে এই জেলার বর্তমান চিত্র রাতারাতি পাল্টে যাবে। অভিশপ্ত দরিদ্র জেলার দুর্নাম হতে মুক্ত হবে। বিশ্বের নানা দেশ হতে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসবে। তিস্তা নদীর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইয়োলো রিভার ইঞ্জিনিয়ারিং, চায়না আর্থিক সহয়তা ঋণ হিসেবে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও অনেক দেশ ও সংস্থা এখানে ঋণ দিতে আগ্রহী হয়েছে। এটা দেশের স্থায়ী সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।