ডেস্ক নিউজ
বিদ্যুত-জ্বালানি মহাপরিকল্পনা-২০২১ তৈরি করতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যুত উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি সংস্থানকে সমন্বয় করে এই পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। চলতি মাসের মধ্যে এজন্য পরামর্শক নিয়োগ শেষ করতে চায় বিদ্যুত বিভাগ। সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে চলতি বছরের মধ্যে নতুন এই পরিকল্পনা সরকারের হাতে আসবে।
অতীতে বিদ্যুতখাতকে প্রাধান্য দিয়ে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) তৈরি করা হতো। এতে বিদ্যুত চাহিদা, উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণকে প্রাধান্য দেয়া হতো। কিন্তু এই বিদ্যুত উৎপাদনে জ্বালানির সংস্থান কিভাবে হবে তার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকত না।
পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান -২০১৬ তে বলা হয়েছিল ২০২১ এরমধ্যে ২৪ হাজার, ২০৩০ এরমধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ এরমধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে। কিন্তু এখন ২০২১-এ এসে দেখা যাচ্ছে দেশে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। অর্থাৎ নয় হাজার মেগাওয়াট রিজার্ভ বিদ্যুত কেন্দ্র থাকছে। যা সাধারণত বছরের বেশিরভাগ সময় বসেই থাকছে। যার জন্য সরকারকে বাড়তি ব্যয়ও করতে হচ্ছে। এই সঙ্কট সামলে এবার জ্বালানি এবং বিদ্যুতের ভবিষ্যত পরিকল্পনাটি একই সঙ্গে করা হচ্ছে।
পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান -২০১৬ এ বলা হয়েছিল মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৫০ ভাগ আসবে কয়লা থেকে। এই কয়লার আবার অর্ধেক হবে দেশীয় কয়লা। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী দেশে ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের কথা। এরমধ্যে অন্তত ৩০ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশের কয়লাখনিগুলোর বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনার আগেই এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও দেশের মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৩০ ভাগ গ্যাস এবং এলএনজি থেকে আসার কথা। কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন সঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি এলএনজির উচ্চ দরের বিষয়টি পরিকল্পনায় মাথায় রাখা হয়নি। এছাড়া বাকি ২০ ভাগ বিদ্যুতের মধ্যে ১০ ভাগ তরল জ্বালানি এবং ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বিদ্যুত জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, মহাপরিকল্পনায় এবার জ্বালানি এবং বিদ্যুতকে এক সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জ্বালানি ছাড়া তো বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমাদের বলা হলো অর্ধেক বিদ্যুত কয়লা দিয়ে উৎপাদন হবে। এরমধ্যে দেশীয় কয়লা অর্ধেক। কিন্তু দেশে এত কয়লার সংস্থান নেই। আমরা যেসব খনিতে সম্ভাব্যতা জরিপ চালিয়েছি সেখান থেকে কয়লা তোলা দুরূহ বিষয়। এর জন্য বিপুল বিনিয়োগ এবং সময়ের প্রয়োজন। সঙ্গত কারণে পরিকল্পনাকে নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। বিদ্যুত জ্বালানির টেকসই উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ দিতে চাই।
এখন দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে সর্বোচ্চ গ্রীষ্মে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এই ১৫ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহের মধ্যে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাকি বিদ্যুত দেশেই উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ দেশে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত এবার গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন করতে হবে। এই বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য দেশের প্রধান জ্বালানি গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হবে সব চাইতে বেশি। চলতি বছর বিদ্যুত উৎপাদনে দৈনিক এক হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দিয়িছে পিডিবি। এই গ্যাসের মধ্যে প্রতিদিন যদি এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসও সরবরাহ করা হয় তা দিয়ে সর্বোচ্চ ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। অর্থাৎ বাকি বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য তেল, কয়লার ওপরই বেশিরভাগ নির্ভর করতে হবে। ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের সংস্থান কমে আসাতে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে আমদানি করা জ্বালানির নির্ভরতা কিভাবে কমিয়ে এনে টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন করা সম্ভব সে বিষয়টি এখন বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন এই পরিকল্পনাকে সফল করতে ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, দেশে ৫৪৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। আগামী ২০২১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত দেশে ২০ হাজার ৭১১ মেগাওয়াট এবং ২০৩১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত ২০ হাজার ৭১১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২০৪১ সালে গিয়ে দেশে মোট ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত আসবে সৌরবিদ্যুত থেকে। সরকারের টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (¯্রডো) সম্প্রতি এই পরিকল্পনায় বিদ্যুত বিভাগের অনুমোদন নিয়েছে।
আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবেল এনার্জি ল্যাবরেটরি (এনআরইএল) গত বছর বায়ু প্রবাহের রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে দেশের কিছু এলাকাকে বিদ্যুত উৎপাদনের উপযুক্ত বলে জানিয়েছে। এনআরইএল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বাংলাদেশে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের স্বক্ষমতা রয়েছে।
জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) তত্ত্বাবধানে বিদ্যুত এবং জ্বালানির মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। এই পরিকল্পনাতে এবারই প্রথম বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টি সমন্বয় করা হবে। করোনার কারণে পরামর্শক নিয়োগ কিছুটা পিছিয়ে গেলেও চলতি মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
এখন গড়ে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট, এছাড়া কয়লা উত্তোলন হয় গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টন। বিদেশ থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির স্বক্ষমতা দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও আমদানি হচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।