সারাবিশ্বে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় গত মার্চ মাসেই বাংলাদেশ থেকে নতুন করে জনশক্তি রফতানি বা বিদেশে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও জনশক্তি রফতানি শুরু হয়নি, আগামী বছরের আগে শুরু হওয়ার কোনও সম্ভবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন জনশক্তি রফতানি হতো। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে পৌনে দুই লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। এরপর করোনার কারণে আর একজন কর্মীও বিদেশ যেতে পারেনি। শুধু তাই নয়, একই কারণে দুই লাখের মতো প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি রফতানি বন্ধ থাকায় এবং দেশে-বিদেশে প্রবাসীরা আটকে পড়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে।
জনশক্তি রফতানি সংস্থা বায়রা ও অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে আগে গড়ে প্রতিমাসে ৬০ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে যেতেন। সেই হিসাবে গত পাঁচ মাসে তিন লাখ কর্মী বিদেশে যেতে পারেননি। আর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন এক লাখের বেশি প্রবাসী। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে এসেছেন আরও এক লাখের মতো প্রবাসী কর্মী। সব মিলিয়ে দুই লাখের বেশি প্রবাসী করোনার কারণে দেশে আটকা পড়েছেন। বিদেশে গমনেচ্ছু নতুন কর্মী এবং আটকে পড়া প্রবাসী— সব মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ লাখ কর্মী সরাসরি করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যদিও সীমিত পরিসরে কয়েকটি দেশের সঙ্গে ফ্লাইট চালু হওয়ায় আটকে পড়া অল্পকিছু প্রবাসী ফিরে যেতে পারছেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয়েছে ৭ লাখ ১৫৯ জন, যা গড়ে প্রতিমাসে ৬০ হাজারের কাছাকাছি। আর ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮১ হাজার ২১৮ জন। গড় হিসাবে এসময়ও প্রতিমাসে ৬০ হাজারের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। মূলত,এরপর থেকে বিদেশে কর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদ বলেন, ‘নতুন করে জনশক্তি রফতানি এখন অনিশ্চিত। কখন কোন দেশ কর্মী নেবে সেটা বলা যাচ্ছে না। এ বছরের মধ্যে নতুন করে আর জনশক্তি রফতানি হবে বলে মনে হয় না।’বেনজির আহমেদ আরোও বলেন, ‘বর্তমানে রিক্রুট এজেন্সিগুলোর কাছে ৮৫ হাজারের বেশি ভিসা রয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে এখন আমরা খুব বিপদে আছি। এসব লোক বিদেশ যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল। এখন তাদেরকে যে কবে পাঠানো যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।’
বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহদাত হোসাইন বলেন, ‘করোনার কারণে এক সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকা ৩০ হাজার লোক আটকে গেছেন। এদের মধ্যে কিছু একেবারেই যাওয়ার জন্য রেডি ছিলেন, অর্থাৎ তাদের এয়ারলাইন্সের টিকিট ও ম্যান পাওয়ার সব কিছু হয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের ১০৬টি দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি হয়। তবে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশেগুলোতে আমাদের শ্রমিক বেশি যায়। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক বিভিন্ন দেশে যান। ’
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত লাখখানেক লোক দেশে ফেরত এসেছেন। এর আগে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ছুটিতে এসে আটকা পড়া প্রবাসীর সংখ্যাও লাখের বেশি। আর মার্চ থেকে আমাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ। সেই হিসাবে আগস্ট পর্যন্ত অন্তত পক্ষে তিন লাখ লোক বিদেশ যেতে পারেনি। অর্থাৎ গড়ে প্রতিমাসে ৬০ হাজার লোক বিদেশে যেতে পারতেন। এরমধ্যে এক লাখ লোকের পাসপোর্ট এবং ভিসা নিশ্চিত করা ছিল। সবকিছু মিলিয়ে সরাসরি ৫ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
একদিকে জনশক্তি রফতানি বন্ধ রয়েছে, অপরদিকে লাখ-লাখ প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। তারপরও গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশে। তবে জনশক্তি রফতানি ও অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন— আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসবে। তাদের মতে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ কম ছিল। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো— প্রবাসীরা তাদের জমানো টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, রমজান ও কোরবানির ঈদে সাধারণ সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেশি আসে, হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ থাকার কারণে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা এসেছে এবং রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ভিসা ক্রয় বন্ধ থাকায়, সেই টাকাগুলো দেশে ফিরে এসেছে। এছাড়া হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ থাকার কারণে যারা স্মাগলিং ব্যবসা করতো, তাদের টাকাও সঠিক পথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এসেছে। এসব কারণে সাময়িক সময়ের জন্য রেমিট্যান্স বাড়লেও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকবে। বরং সংশ্লিষ্টরা মনে করেন যে, জনশক্তি রফতানি বন্ধ থাকায় এবং প্রবাসীরা আটকে পড়ার কারণে রেমিট্যান্সের ওপরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছে এক লাখ ৫৫ হাজার ২১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, আর ডলার হিসাবে ১৮ হাজার ৩৫৪ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৫৯ হাজার ২৯৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, আর ডলার হিসাবে ৬ হাজার ৯৬৪ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর গত জুন মাসে রেকর্ড পরিমাণ ১৮৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অতীতে কোনও একক মাসে এত বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসেনি।
অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, ‘এখন যে রেমিট্যান্সটা আসছে তার নানা রকম কারণ আছে। বিভিন্ন দেশে যেসব শ্রমিক আছেন, নানা কারণে তাদের চাকরি চলে যাবে, বা চাকরি হারানোর শঙ্কা আছে। ফলে তারা সেখানে জমানো যে টাকা ছিল, সেগুলো দেশে পাঠাচ্ছেন। এটা একটা ফ্যাক্টর। দ্বিতীয়ত, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সবসময় বিভিন্ন দেশ থেকে ভিসা কিনতো, এখন যেহেতু সবকিছু বন্ধ, যার ফলে তারা টাকাগুলো দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আগে এসব টাকা হুন্ডি করে আসতো, এখন হুন্ডি বন্ধ থাকায় সঠিক চ্যানেলে টাকাগুলো দেশে আসছে। তারপর যারা স্মাগলিং করতো তাদেরও হুন্ডির প্রয়োজন হতো, সেটা যেহেতু এখনও চালু হয়েনি ফলে সেগুলোও এখন প্রোপার চ্যানেলে আসছে। এসব বিষয়ে আমাদের খেয়াল করতে হবে। ফলে এখন যে অনেক বেশি রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে, সেই প্রবণতা বেশিদিন থাকার কথা না। সেটা কিছু দিন থাকবে, তারপর কমে যাবে। ’
বায়রার সভাপতি বেনজির আমহেদ বলেন, ‘রেমিট্যান্স তো জনশক্তি রফতানির ওপর নির্ভর করে। সেটা অলরেডি ব্লক হয়ে গেছে। রেমিট্যান্সে তো এর প্রভাব পড়বেই। দারুণভাবে প্রভাব পড়বে। সেটা হয়তো এখন বোঝা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন কর্মী বিদেশে যাওয়া বন্ধ থাকার পাশাপাশি পুরনো অনেকে দেশে এসে আটকা পড়েছেন, আবার অনেক দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা এখন বেকার হয়ে গেছেন। ফলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেমিট্যান্সে পড়বে— যা পুরোপুরিভাবে আগামী বছরের শুরুতেই দৃশ্যমান হবে।’
সরকার হারাচ্ছে রাজস্বঃ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনশক্তি রফতানি বন্ধ থাকায় সরকার হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। যেকোনও দেশে নতুন শ্রমিক যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে জনপ্রতি ট্যাক্স দিতে হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। সেই হিসাবে বছরে আট লাখ নতুন জনশক্তি রফতানি হলে সরকার রাজস্ব পায় ২৮০ কোটি টাকা। আবার এসব লোক এয়ারলাইন্সের টিকিট ক্রয়ের সময়ও জনপ্রতি সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাইরে মিনিমান তিন হাজার টাকা ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। এছাড়া বিমানবন্দর ফিসহ আরও কয়েকটি খাতেবিদেশগামীদের সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়। সব মিলিয়ে এই খাত থেকে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে হচ্ছে সরকারকে।
বায়রার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহদাত হোসাইন বলেন, ‘নতুন জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয় সরকারকে। এরবাইরে টিকিট ইস্যুর সময়ও ট্যাক্স দিতে হয়। ’
সংকটে বিদেশগামী কর্মী ও এজেন্সি সমূহঃ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটি এজেন্সি-বায়রা’র হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১৫৭০টি রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। এসব এজেন্সির তালিকাভুক্ত লাখের বেশি কর্মী বিদেশ যাওয়ার জন্য ভিসা প্রক্রিয়া শেষ করে অপেক্ষায় ছিলেন। এতে হাজার কোটি টাকা আটকা পড়েছে এজেন্সি ও বিদেশগামী কর্মীদের।