বাস্তবায়নের একেবারে দ্বারপ্রান্তে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা বহুমুখী সেতুর মূল অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। সেতুটি এখন এক মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরেই মিলন ঘটছে পদ্মা সেতুর দুই কূলের। আর মাত্র ৮টি পিলারের ওপর ১০টি স্প্যান বসানো বাকি রয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরার কূলে বেশ আগেই মাটি স্পর্শ করেছে পদ্মা সেতু। বাকি দশটি স্প্যান বসলেই সেতুটি পদ্মা নদীর মাওয়া প্রান্তের মাটিও স্পর্শ করবে। দুই কূলের মানুষ এখন এই সুন্দর মুহূর্তটি দেখার অপেক্ষায় আছে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার দুই কূল সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
অবশ্য পদ্মার দুই কূলের মিলন আরও ঘনিয়ে আসত এতদিনে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অন্তত পাঁচটি স্প্যান খুঁটির ওপর বসানোর লক্ষ্য ছিল কর্তৃপক্ষের। তবে মাওয়া প্রান্তের মূল পদ্মায় প্রচণ্ড স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় এ সময়ে একটি স্প্যানও বসানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া নজিরবিহীন ভাঙনেও কাজের ক্ষতি হয়েছে। মূল সেতুতে এরই মধ্যে ৩১টি স্প্যান বসানো হয়ে গেছে। ৪২টি খুঁটির ওপর বসানো হবে ৪১টি স্প্যান। বাকি ১০টি স্প্যান এখন মাওয়া প্রান্তের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি স্প্যান এখনই খুঁটির ওপর বসানোর জন্য প্রস্তুত। কিন্তু নদীতে প্রচন্ড স্রোতের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, বর্ষাকাল এসে যাওয়ায় এবং এবার পদ্মার মূল অংশে প্রবল স্রোত হওয়ায় স্প্যান বসানোর কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। নতুবা এতদিনে আরও ৫ থেকে ৬টি স্প্যান বসানো হয়ে যেত। তা ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে কনস্ট্রাকশন কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে নদীর স্রোত কমে এলে স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যেই ৭টি স্প্যান সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। বাকি তিনটিও প্রস্তুত করা হচ্ছে। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই বাকি ১০টি স্প্যান বসানোর কাজ সম্পন্ন হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এখন দেশের সর্ববৃহৎ সেতুটির নির্মাণ কাজ চলছে পুরোদমে। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া অংশে নদীর পাড় ঘেঁষে যে ওয়্যারহাউসটি রয়েছে সেখানে রাত-দিন পরিশ্রম করে শ্রমিকরা নির্মাণ করছেন বাকি স্প্যানগুলো। সেই সঙ্গে মাওয়া অংশের স্থলভাগের যেসব কাজ বাকি আছে তা সম্পন্ন করতে কাজ চলছে পুরোদমে।
এখানে কর্মরত পদ্মা সেতু প্রকল্পের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে জানান, মূল সেতুর ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে স্থাপন হয়েছে ৮৯৩টি এবং ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে স্থাপন হয়েছে ১ হাজার ৪৮৮টি। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের বা ঝুলন্ত সেতুর মধ্যে ৪৮৪টি সুপার গার্ডারের মধ্যে ২০০টি স্থাপনের কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩১টি স্প্যান বসানোর পর পদ্মা সেতুর মূল অবয়ব দৃশ্যমান হয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ মিটার। ইতোমধ্যেই জাজিরা প্রান্তের সব স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন মাওয়া প্রান্তে থাকা ৮টি খুঁটির ওপর ১০টি স্প্যান স্থাপনের কাজ শেষ হলেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে দ্বিতল পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হবে।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের স্বপ্নের এই পদ্মা সেতুর মূল কাজ সংশোধিত সময় অনুযায়ী সমাপ্তির সময় রয়েছে ২০২১ সালের ৩০ জুন। তবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ২০২২ সালের আগে নির্মাণ কাজ শেষ হচ্ছে না।
একদিকে পদ্মা সেতুর মূল আবকাঠামো তৈরির কাজ যখন পুরোদমে চলছে ঠিক তখনই সেতুর সঙ্গে দুইপারের যে সড়ক যুক্ত হবে সেগুলো এখন শতভাগ প্রস্তুত। সেতুর উভয়পাশে যে সড়ক তৈরি করা হয়েছে তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। রাজধানী ঢাকা থেকে এসে মাওয়ার অংশে যে সড়ক ঠেকেছে তার পুরোটাই একেবারে ঝকঝকে-তকতকে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে কেরানীগঞ্জে প্রবেশ করলেই মনে হবে অন্য কোনো জগতে এসেছি। কোনো রকম ডিভাইডার ছাড়া এক টানে চলে আসা যাবে মাওয়াতে। সড়কটি মাওয়া ঘাটে পদ্মা সেতুর সঙ্গে মিলবে যেখানে ঠিক সেখানে সেতুর গোড়ায় সামান্য কাজ বাকি রয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হতে মাসখানেক সময়ও লাগবে না বলে জানিয়েছেন কর্মরত প্রকৌশলীরা।
আর পদ্মার ওপারে অর্থাৎ শরীয়তপুরের জাজিরা অংশে পদ্মা সেতু যে রাস্তার সঙ্গে মিশবে সে রাস্তাও শতভাগ প্রস্তুত। স্থলভাগে মাত্র ২০০ গজের মতো রাস্তা সেতুর সঙ্গে ঠেকতে বাকি রয়েছে। এই সংযোগমুখে একটি গর্ত রয়েছে। সেটি ভরাট করা হচ্ছে। এই অংশটুকু ভরাট হলেই জাজিরার সড়কপথের সঙ্গে মিশে যাবে পদ্মা সেতু। এই পয়েন্টের সড়কপথে টোল প্লাজাও বসে গেছে এবং টোল প্লাজা পরিচালনার জন্য ঘরসহ সব রকম অবকাঠামোও সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
পদ্মা সেতুর চলমান কাজের অন্যতম ভালো লাগার বিষয় হলো জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ওপর সড়ক ও রেলসেতুর অংশে রাস্তা নির্মাণের জন্য ৩ কিলোমিটারের বেশিতে স্ল্যাব বসানো হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেতুতে গাড়ি চলাচলের জন্য এই ৩ কিলোমিটার রাস্তায় বিটুমিন ঢালাইও সম্পন্ন হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়ে জাজিরা পয়েন্টে কর্মরত এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সময়ের আলোকে জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর ওপর প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়িগুলো উঠতে পারবে। তখন স্ল্যাব বসানো এবং ঢালাইয়ের কাজে আরও গতি আসবে। তিনি আরও বলেন, সব মিলিয়ে এখন যে গতিতে কাজ চলছে তাতে আমরা আশা করছি ২০২১ সালের শেষ নাগাদ পদ্মা সেতু গাড়ি চলাচলের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাবে। সে অর্থে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের যে স্বপ্ন তা বাস্তবায়ন হতে আর বেশি দেরি নেই।
এদিকে পদ্মা সেতুর কাজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মার দুইপারের মানুষগুলো ততই আশায় বুক বাঁধছে। এ সেতুকে ঘিরে তাদের আশা-আকাক্সক্ষার শেষ নেই। যেমন মাওয়া অংশে একেবারে পদ্মা সেতু প্রকল্পের গা ঘেঁষে বসবাস করা দক্ষিণ কুমারভোগ এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম খান সময়ের আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু যেমন সারা দেশের মানুষের কাছে একটি স্বপ্নের বিষয়, তেমনি আমরা যারা সেতুর নিকটের বাসিন্দা তাদের কাছে এই সেতু একটি গর্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুন্সীগঞ্জবাসী কৃতজ্ঞ। কারণ তিনি সাহস করে দেশীয় টাকায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না করলে মুন্সীগঞ্জবাসীর এ স্বপ্ন হয়তো এত তাড়াতাড়ি পূরণ হতো না। পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। এ সেতুকে ঘিরে এখন আমাদের অনেক স্বপ্ন।