ডেস্ক নিউজ
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন বিভিন্ন দফতরে ৩২টি উৎস চিহ্নিত করে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রবিবার (২০ মার্চ) সন্ধ্যায় ওই প্রতিবেদন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে জমা দেওয়া হয়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশও রয়েছে এতে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা এবং প্রতিরোধে সুপারিশ করা যতটা সহজ, এর বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বশীলদের ভূমিকা রয়েছে। কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রধানকর্তা যদি চান, তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানে তিনি কোনও ধরনের দুর্নীতি হতে দেবেন না, তবেই প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। একই সঙ্গে সরকারেরও এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। দুদকের একার পক্ষে দেশ থেকে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
দুদকের জনসংযোগ শাখার উপ-পরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক জানান, ২০২০ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন আবদুল্লাহ, দুই কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান (অনুসন্ধান) ও জহুরুল হক (তদন্ত) এবং দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বঙ্গভবনে যান। চার সদস্যের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির কাছে দুই বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেন।
দুদকের ওই কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৯(১) ধারা মোতাবেক প্রতিবছর দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক অতিমারির কারণে ২০২০ সালের প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় এ বছর ২০২০ ও ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন একত্রে প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালের জন্য তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে কমিশনের কার্য-সম্পাদন, সম্পাদিত কাজের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জবাবদিহি এবং সরকার প্রদত্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত তথ্যসহ কমিশনের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষ থেকে মোট ৩২টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত করা এসব দুর্নীতির উৎস বন্ধ করতে ২৪টি সুপারিশও করা হয়েছে। দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দফতরের মধ্যে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়, মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধে বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে স্ব-উদ্যোগে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক টিমগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি ও জনসেবা সংক্রান্ত সফলতা ও সীমাবদ্ধতার দিকগুলো পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নযোগ্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে প্রেরণ করেছে।
কমিশন মনে করে, সংশ্লিষ্ট সকলে এসব সুপারিশ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করলে দুর্নীতির সুযোগ রোধের মাধ্যমে এসব খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম এবং সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তিতে জনহয়রানি লাঘব হবে।
দুদক বলছে, বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত ও সুপারিশ করা ছাড়াও দুই বছরের কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেছেন। দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক শক্তিকে জাগ্রত করার প্রয়াসে নানাবিধ অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি পালন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এবং শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করে সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৯টি সততা সংঘ গঠন এবং ৫ হাজার ৭৫৬টি সততা স্টোর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের লকডাউন সামলে বর্তমানে নতুন কমিশন প্রতি সপ্তাহে একটি করে কমিশন সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ফলে বিগত বছরগুলোতে যেখানে বছরে ১০-১২টি সভা হতো সেখানে মাত্র আট মাসে প্রায় ২৫টি কমিশন সভা সম্পন্ন হয়েছে। একই সঙ্গে কমিশনের বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সাফল্য অব্যাহত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২০ সালে নিম্ন আদালতে দুদক ও বিলুপ্ত ব্যুরোর মোট বিচারাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি মামলার মধ্যে ১৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে ১২১টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৭২ শতাংশ এবং বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৬৮.৭৫ শতাংশ।
এছাড়া ২০২১ সালের মোট ৩ হাজার ৪৩৪টি মামলার মধ্যে ২০৩টির নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে কমিশনের পক্ষে রায় হয়েছে ১১৯টিতে। কমিশনের মামলায় সাজার হার ৬০ শতাংশ এবং বিলুপ্ত ব্যুরোর মামলায় সাজার হার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ গড়ে সাজার হার শতকরা ৫৮.৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৯ সাল থেকে এনফোর্সমেন্ট সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। কোভিড-২০১৯ এর কারণে আগের তুলনায় অভিযান পরিচালনা কম হলেও এই ইউনিটের মাধ্যমে ২০২০ সালে ৪৮৭টি এবং ২০২১ সালে ২৪৫টি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সাল থেকে গোয়েন্দা ইউনিট কমিশনের সাংগঠনিক কাঠামোতে যুক্ত হয়েছে। ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ৬৬৫টি অভিযোগ গোপনে তথ্যানুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়, যার মধ্যে ২৫০টির নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ৪১৫টি অভিযোগের গোপন তথ্যানুসন্ধান চলমান রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানের পর গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে কমিশন চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে ১৫৪টি অভিযোগ প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, কমিশনের দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেল (যাচাই-বাছাই কমিটি) ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ বাছাই করে ৮২২টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে এবং ২৪৬৯টি অভিযোগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দফতরে পাঠিয়েছে। ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ থেকে ৫৩৩টি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ এবং ২ হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে কমিশনের স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট যাত্রা শুরু করে। ওই ইউনিটের অধীনে ২০২০ সালে আদালতের আদেশে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে এবং ১৫২ কোটি ৯২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৯৬ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
২০২১ সালে ৩২৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৮ টাকার সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে এবং ১ হাজার ১৬১ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ টাকার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার) অবরুদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।