ডেস্ক নিউজ
দুর্যোগ ঝুঁকি বিশ্বব্যাপী ক্রমশ বেড়ে চলছে। এর মূল কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ভুমি ব্যবহার, ভবিষ্যত বিপদের কথা না ভেবে ঢালাও অবকাঠামো উন্নয়ন, জনসচেতনতার অভাব এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংক্রান্ত পরিকল্পনাহীনতা। কপ-২৫ এ প্রকাশিত জার্মান প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্টাল গ্রীন ওয়াচ এর হিসাব মতে- দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। অন্যদিকে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বিপদাপন্নতায় বিশ্বে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোড মডেল। নানা পরিকল্পনার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠ ও ইউএসএআইডি আয়োজিত ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পেশ করা মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ইডব্লিউএমজিএল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব মো. মহসীন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ, বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।
ইডব্লিউএমজিএল পরিচালক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী। বিশেষজ্ঞ বক্তার বক্তব্য রাখেন পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারোবিলিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারী জেনারেল মো. ফিরোজ সালাহউদ্দিন, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট এডাপটেশন এর ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্ট আব্দুল লতিফ খান এবং ইউএসএআইডি এর মিশন ইঞ্জিনিয়ার (অফিস অব ফুড, ডিজাস্টার এন্ড হিউম্যানিটেরিয়ান এসিস্ট্যান্টস) মাহাবুব জামান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব মো. মোহসীন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশকে দুর্যোগ পোহাতে হবে, তারা তাদের নেতা মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আমরা যখন কোনো আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যাই, তখন দেখি বিভিন্ন দেশের নেতারা শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব থাকেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় কি করতে হবে তা তিনি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন’।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তা নদীতে হঠাৎ পানি বেড়েছে এই কথাটি ঠিক নয়। বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে নেপাল থেকে। সে বন্যা পুবের দিকে সরে এসে গ্যাংটকে বৃষ্টিটা হয়। ভারতের দার্জেলিংয়ে বৃষ্টি হয়েছে. বাংলাদেশে বৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে তিস্তার পানি অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। এর প্রেক্ষিতে তিস্তা ব্যারাজ ভেঙ্গে যেতে পারতো। আসলে পানি ঢুকার পর যে এলাকা দিয়ে পানি বের করে দেওয়া হবে সেটি চিহ্নিত থাকার পরও আমরা সে এলাকার লোকদেরকে প্রস্তুত করতে পারিনি। এখানেই হচ্ছে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের দূর্বলতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের সংখ্যা, তীব্রতা ও মাত্রার ব্যপকতাও ক্রমবর্ধমান। তবে পৃথিবীতে সংঘটিত দুর্যোগসমূহের ৪৫ শতাংশ এশিয়া মহাদেশে হয়ে আসছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির ৪২ শতাংশ, হতাহতের ৮৩ শতাংশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যা ৮৬ শতাংশের অবস্তান এই মহাদেশে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে ‘দুর্যোগের সুপারমার্কেট’ বলা হয়। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে। যার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সরাসরি তত্ত্ববধানে, মন্ত্রী ও সচিব মহাদয়ের নির্দেশনায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কাজের ছলে কাজ নয়, এটি থেকে বের হয়ে আসা হয়েছে। আগে কোন প্রশিক্ষন ইন্সটিটিউট ছিলো না, এখন অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে।
ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারোবিলিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, বাংলাদেশে দূর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সফলতার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে টিম স্পিরিট। ২০২০ সালে আম্পানের সময় উপকূলীয় এলাকা থেকে আমরা ২৬ লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে পেরেছিলাম। যাতে আমাদের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারী জেনারেল মো. ফিরোজ সালাহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি মানবিক সাহায্য সংস্থা। যে কোন দুর্যোগে সাহায্যর প্রয়োজন হয় যারা সুস্থ থাকে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে সাত লাখ ভলেন্টিয়ার আছে। যত রকম দুর্যোগ আসুক না কেন রেড ক্রিসেন্ট সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এন্ড ক্লাইমেট এডাপটেশন এর ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্ট আব্দুল লতিফ খান বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দেশ অনেক উন্নতি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পড়ানো হচ্ছে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য অবকাঠামো এবং অবকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়- এ বিষয়গুলোতে মনযোগী হওয়া দরকার।
ইউএসএআইডির মিশন ইঞ্জিনিয়ার মাহাবুব জামান বলেন, ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গত ২০ বছরে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৭০০ টিরও বেশি সাইক্লোনশেল্টার তৈরি করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে ইউএসএআইডির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৯৬টি বিদ্যমান ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রকে পুননির্মাণ করছে, যাতে এগুলো একই সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয় ও স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সেইসঙ্গে ২৫টি নতুন বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।