স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ছিল ‘রিলিফ চোর’দের ফায়দা লোটার তৎপরতা। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে অর্থনীতির চাকা যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সে বিষয়টি অনেকটা আড়ালেই থেকে যায়।
ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছে- ‘চীন তো অনেক দূর, ক্ষুধা সূচকে পাকিস্তান-বাংলাদেশের থেকেও পিছিয়ে ভারত’। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের চেয়ে যথেষ্ট ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ। এটাও লক্ষণীয় যে লাল-সবুজের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বেশ ভালো ব্যবধানেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। যেমন দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, জিডিপি, শিক্ষার হারসহ অনেক সূচকে। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাদেশের আগে ক্ষুধা সূচকে পাকিস্তানের নাম রেখেছে ‘শত্রুতার’ কারণে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাস্কেট কেস কিংবা বটমলেস বাস্কেট হিসেবে উপহাসের শিকার হয়েছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ কিছু লোকের কাছে বেশ উপভোগ্য শব্দ ছিল। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ভারতের চেয়ে আর্থ-সামাজিক নানা সূচকে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমরা নিজেদের চেষ্টায় ভালো অবস্থানে যেতে পেরেছি। এ যে বড় অর্জন। এর স্বীকৃতিও মিলছে।
‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও: বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়’- এটা ছিল ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার ১৫ অক্টোবরের সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম। আগের দিন (১৪ অক্টোবর) আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিল- ‘পড়ছে ভারত! মাথা পিছু উৎপাদনে ‘‘অচ্ছে দিন’’ যাচ্ছে বাংলাদেশে’।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু বলেছেন- ‘এমার্জিং ইকোনমির যে কোনো দেশের এগিয়ে যাওয়া ভালো সংবাদ। বাংলাদেশ ২০২১ সালে মাথা পিছু জিডিপিতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫ বছর আগে জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল।
দি প্রিন্ট-এর প্রধান সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক শেখর গুপ্ত ১৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর চলতি অর্থ বছরের প্রতিবেদন ভারতের অর্থনীতির অ্যাকিলিস হিল বা সবচেয়ে দুর্বল স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ সংস্থার আয়না ভারতের জন্য বড়ই নিষ্ঠুর!
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট বার্তায় বলেছেন- ‘গত ৬ বছরে বিজেপির বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দুর্দান্ত সাফল্য হলো- বাংলাদেশ ভারতকে ছাপিয়ে যেতে চলেছে’।
আইএমএফ বলেছে- ভারতের মাথা পিছু জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি দাঁড়াবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকার কিছু বেশি)। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মাথা পিছু উৎপাদন হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা)।
বাংলাদেশের কাছে এমন হার ভারতের ক্ষমতাসীনদের জন্য দুঃস্বপ্ন বৈকি। এটাও লক্ষণীয় যে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের অর্জনকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারকে দেওয়া হয়েছে সাধুবাদ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রদর্শিত পথ থেকে শিক্ষা গ্রহণেরও আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এর তেমন প্রতিফলন নেই। কোথাও তেমন আলোচনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
করোনা হানা দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত সংস্থা ও ব্যক্তিরা বরং নেতিবাচক দিকগুলোকেই বেশি বেশি সামনে এনেছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিবিসির আকবর হোসেনের এক প্রতিবেদনের কথা। তিনি প্রশ্ন তোলেন- ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প টিকে থাকতে পারবে?’ রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। বছরে রফতানির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু সামনে কেবলই দুঃসময়।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক ওই সময়েই বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন- ‘কোনো ক্রেতাই এখন প্যান্ট-শার্ট কিনবে না, কিনবে খাবার ও ওষুধ’। প্রতিদিন টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে তার উদ্ধৃতি দিয়ে খবর থাকত- শত শত কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। আরও বাতিল হচ্ছে।
১ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম খবর প্রকাশ করে- পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষতি ১৬০০ কোটি টাকা ছাড়াবে। ৫ এপ্রিল ইত্তেফাকের একটি খবরের শিরোনাম- ‘জাহাজনির্মাণ শিল্প ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে’। আরেকটি দৈনিকে খবর প্রকাশ হয়- পরিবহন খাতের ৮০ লাখ শ্রমিকের সহায়তায় কেউ এগিয়ে আসে নাই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি বলেছে- ২০১৯-২০ অর্থ বছরে জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২.৫ শতাংশে নেমে যাবে, যা ৩০ বছরে সবচেয়ে কম। বেকারের সারিতে নতুন কত কোটি নারী-পুরুষ নাম লেখাবে- গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ছিল ‘রিলিফ চোর’দের ফায়দা লোটার তৎপরতা। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে অর্থনীতির চাকা যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সে বিষয়টি অনেকটা আড়ালেই থেকে যায়।
আইএমএফ-এর প্রতিবেদন ভারতকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ যে ঝঞ্ঝা-ঝড়-দুর্বিপাকেও মাথা নোয়াবার নয়- সেটা কি সকলে উপলব্ধি করে?
শেখর গুপ্ত আইএমএফ-এর ঝাঁকুনি দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনার সময় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত স্বাতী নারায়নের এক প্রতিবেদনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ওই সময়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এক মন্ত্রী বিদ্বেষপ্রসূতভাবে বলেছিলেন- ‘নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক ভারতে চলে আসবে’। স্বাতী নারায়ন প্রশ্ন তুলেছিলেন- কেন আসবে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়িতে টয়লেট, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্কুল-কলেজে ছাত্রী ভর্তি, নারী কর্মী, সাক্ষরতার হার- এ সব অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তারা বিনামূল্যে প্রতি বছর চার কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যবই দিচ্ছে। বাংলাদেশ কেবল মাথা জিডিপিতেই ভারতের থেকে সামান্য পিছিয়ে। শেখর গুপ্ত বলেছেন- এখন জিডিপিতেও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
শুধু এ বছর নয়, সামনের জন্য যে ভবিষ্যদ্বাণী আইএমএফ করেছে, সেটাও নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য সুখকর হয়নি। সংস্থাটি বলছে- আগামী বছর ভারতের জিডিপি মাথা পিছু হবে ২০৩০ ডলার, বাংলাদেশের ১৯৮৯ ডলার। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলার আনন্দ স্থায়ী হবে না। কারণ ২০২৪ সালে দুই দেশের জিডিপি সমান হয়ে যাবে, বাংলাদেশ এগিয়ে থাকবে পয়েন্টের ব্যবধানে। আর পরের বছর, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ২৭৫৬ ডলার, ভারতের ২৭২৯ ডলার।
এটা পূর্বাভাস, ঠিকঠাক হবেই- এমন কথা নেই। গড় জিডিপিতে ১০-১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক আর হতদরিদ্রকে সমান করে দেখানো হয়, এটাও ভুললে চলবে না। শ্রীলংকার মাথাপিছু জিডিপি ২০২০ সালেই ৩৭০০ ডলার, চীনের প্রায় ১১ হাজার ডলার। এ তথ্যের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানা সমস্যা আছে। দুর্নীতি-অনিয়ম বিস্তর। ধর্মান্ধ অপশক্তি বার বার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
আইএমএফ-এর পূর্বভাস প্রকাশের পর ভারতের অনেকেই নতুন প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশ পলিসি’ নির্ধারণের অনুরোধ করেছেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয় করার অবস্থান থেকে সরতে বলেছেন। ‘ম্যালাইন’ কোনোভাবেই নয়- বিশেষভাবে এটা তারা বলেছেন। শেখর গুপ্ত আরও বলেছেন- পাকিস্তানকে ঘিরেই যে এ অঞ্চলের বিদেশ নীতি নয়াদিল্লির, তার পরিবর্তন জরুরি। বাংলাদেশকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, ভারত ততটা দিচ্ছে না- এটাও কিন্তু অভিযোগ এবং তা অমূলক বলা যাবে না।
আইএমএফ-এর ঝাঁকুনির পর ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চের ‘বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২০’ প্রতিবেদনও ভারতের ক্ষমতাসীনদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। তারা বলেছে, গত বছর ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮, এবারে ৭৫-এ উঠে এসেছে। আগের তিন বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০। অপুষ্টির হারসহ চারটি মানদণ্ড তারা বিচেনায় নেয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ৯৪তম, পাকিস্তানের ৮৮ ও আফগানিস্তানের ৯৯। ভারত কেবল এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারে- পাকিস্তান তো হারাতে পারেনি!