বিদায়ী বছর শুরু হয়েছিল অর্থনীতিতে নানা টানাপোড়েন দিয়ে। রপ্তানির অবস্থা ভালো ছিল না। রাজস্ব আয় ছিল দুর্বল। উৎপাদন ও বিনিয়োগে ধীরগতি ছিল। ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। শেয়ারবাজার ছিল নাজুক। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি ছিল। কৃষি খাতেও উদ্দীপনা দেখা গেছে। এর পর তিন মাস যেতেই আঘাত আনে করোনাভাইরাস।
এপ্রিলের পরিসংখ্যানেই অর্থনীতিতে করোনার ধাক্কা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রপ্তানিতে ধস নামে। বহু মানুষ কাজ হারান। বেড়ে যায় দারিদ্র্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এক লাখ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে মূলত কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ব্যক্তি খাত টিকে থাকার লড়াই শুরু করে। উন্নয়ন সহযোগীরা পাশে দাঁড়ায়। এতে করে বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্থনীতিতে কিছুটা পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা দেয়। বছরের শেষভাগে এসে করোনার টিকার অগ্রগতি আশাবাদী করে তুলেছে বিশ্বকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সে আশার সঙ্গে শামিল হয়েছে। তবে এখনও অতিমারির আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব হয়নি। বলা যায়, স্বস্তির পথ খুঁজে পেয়েছে অর্থনীতি।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা বলছে, স্বাস্থ্য ও অতিমারি ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ভালো করেছে। তাদের এমন মত বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দৃশ্যমান। মোটা দাগে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অর্থনীতিতে গতি ফিরছে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। বেসরকারি খাতে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। রেমিট্যান্স স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও বেশি আসা শুরু হয়েছে। বিজয়ের মাসে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হওয়ায় মানুষ করোনার মধ্যে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে।
করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ সরকার লকডাউনের আদলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারখানাসহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। বাংলা নববর্ষ এবং ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ে। এপ্রিলে রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের ধস নেমে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের আয় হয়। গত বছরের একই মাসের চেয়ে কমে যায় ৮৩ শতাংশ। এপ্রিলে প্রবাসীরা পাঠান মাত্র ১০৯ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই মাসের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে মে মাসেও নেতিবাচক পরিস্থিতি থাকে।
দেশে ও বিদেশে লকডাউন প্রত্যাহার এবং শিথিল হওয়ায় জুন থেকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স পরিস্থিতির উন্নতি হয়। এর পর থেকে বছরের বাকি সময় রেমিট্যান্স বেশ চাঙ্গা হয়। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪১ শতাংশ। রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতোমধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রপ্তানি চাঙ্গা না হলেও নেতিবাচক ধারায় যায়নি। গত পাঁচ মাসে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ।
করোনার জন্য প্রণোদনার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। প্রণোদনার কারণে কাগজ-কলমে ব্যাংকের আর্থিক সূচকে উন্নতি হয়েছে। বাড়তি তারল্যের প্রভাবে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমেছে। ঋণ পরিশোধ না করলেও বিদায়ী বছরে কোনো ব্যাংক গ্রাহককে খেলাপি করা হয়নি। এ কারণে খেলাপি ঋণ কমেছে। ব্যাংকে আমানত পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে। শেয়ারবাজারের অবস্থা বছরের শেষ দিকে এসে ভালো হয়েছে। এক বছরে প্রধান সূচক বেড়েছে প্রায় এক হাজার পয়েন্ট। রাজস্ব আয় খুব বেশি না বাড়লেও মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে। গত পাঁচ মাসে রাজস্ব আয় বড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।
করোনার প্রভাবে আমদানি অনেক কমে গেছে। জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে আমদানি কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। বেশি হারে কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। গত পাঁচ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশ। দেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ পরিসংখ্যান না থাকলেও এই পরিসংখ্যান বলে দেয়, বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ পরিসংখ্যান রয়েছে। গত পাঁচ মাসে নিট এফডিআই কমেছে ৪৩ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগ কমলেও করোনার জন্য বিদেশি ঋণ বেড়েছে।
করোনার মধ্যে কৃষি খাত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। আমনের উৎপাদন গতবারের চেয়ে কিছুটা কম হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। মূল্যস্ম্ফীতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা সম্প্রতি বাড়ছে। গেল নভেম্বরে মূল্যস্ম্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। চালের পাশাপাশি পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের দাম ক্রেতাদের ভুগিয়েছে। সবজির দাম মাঝে চড়া থাকলেও এখন কমেছে। করোনার মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন ও পরিশোধ ব্যবস্থা বেড়েছে। করোনা সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবসা বেড়েছে।
দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি :বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিআইডিএস এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, এপ্রিল-জুন সময়ে দারিদ্র্য বেড়ে যায় এবং কর্মসংস্থান কমে যায়। দুটি ক্ষেত্রেই জুলাই থেকে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তবে এখনও আগের জায়গায় ফেরেনি। দারিদ্র্যের ওপর পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জাতীয় জরিপ হয় ২০১৬ সালে এবং তখন এ হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্কলন ছিল, ২০১৯ সালের জুনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। কমিশনের সর্বশেষ প্রাক্কলন হলো, কভিডের কারণে গত জুনে দারিদ্র্য হার বেড়ে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। অতি দারিদ্র্যের হার গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কর্মসংস্থানের ওপর পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ করে। জাতীয় ওই জরিপে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার সময়ে সংস্থাটির এক টেলিফোন জরিপে দেখা গেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই সময়ে বেকারত্বের হার বেড়ে ২২ শতাংশ হয়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে আরও খারাপ চিত্র পাওয়া যায়। তবে জুলাইয়ের পরে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং অব্যাহত রয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে বলা হয়েছে, লকডাউন উঠে যাওয়ার পর ৬০ শতাংশের বেশি ক্ষুদ্র ও অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান আবার চালু হয়।
বিশেষজ্ঞ মত :বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই লিড ইকোনমিস্ট সমকালকে বলেন, ২০২০ সালের শুরুর দিকে অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি সূচকের অবস্থা দুর্বল ছিল। এ অবস্থায় করোনা এসে সবকিছু তছনছ করে দেয়। গত কয়েক দশকে দারিদ্র্য কমার প্রবণতা উল্টো দিকে মোড় নেয়। অনানুষ্ঠানিক খাত বিশেষত সেবা খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসা ও কার্যক্রম মারাত্মক ক্ষতিতে পড়ে। আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা লাগে। শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। রপ্তানি কমে যায়। ছোট ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। এর প্রভাবে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। লকডাউন তুলে নেওয়ার পর কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় অর্থনীতি। এখন রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান ভালো করছে তারা এখনও উৎপাদন ক্ষমতার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, এপ্রিল থেকে জুনের তলানি অবস্থা থেকে উঠে এসেছে। তবে এখনও কভিড-পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বছরের শেষ দিকে এসে করোনার টিকা নিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। উন্নত দেশে টিকাদান শুরু হয়েছে। এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও কিছু দিনের মধ্যে টিকা দেওয়া শুরু হবে। হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার মতো জনসংখ্যা টিকা পেয়ে গেলে অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। নিরাপত্তাহীনতা কেটে গেলে এত দিনকার দমিত চাহিদা চাঙ্গা হয়ে উঠবে। তখন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির নতুন জোয়ার তৈরি হতে পারে।